এবার কম্বোডিয়ায় চীনের দখলাভিযান

কম্বোডিয়ার সবচেয়ে বড় দাতা, বিনিয়োগকারী ও পাওনাদার দেশ চীনকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে আশঙ্কা কম্বোডিয়াবাসীর মনে গেঁথে আছে, সেটি হলো দেনার সুযোগ নিয়ে চীন দেশটিতে সামরিক উপস্থিতি ঘটাতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর একটি প্রতিবেদনমতে, সেই আশঙ্কা এখন সত্যি হওয়ার পথে। কারণ, চড়া সুদের মহাজনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠা আত্মনিয়ন্ত্রণহীন জুয়াড়ির মতো কয়েক বছর ধরে কম্বোডিয়া চীনের কাছ থেকে একের পর এক বিপুল অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে এবং চুক্তিমতো তা শোধ করতে পারছে না।

বহু আগে থেকেই চীন ‘ঋণের জালে জড়ানোর কূটনীতি’ চর্চা করে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে ঋণের জালে আটকে তারা মোক্ষম সময়ে সেই জাল গোটাতে শুরু করে। এখন দেখা যাচ্ছে চীনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, সম্প্রতি এই দুই দেশের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয়েছে, যার মাধ্যমে থাইল্যান্ড উপসাগরে কম্বোডিয়ার রিয়াম নৌঘাঁটির একটি অংশকে চীনের বিশেষ ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।

চীন এবং কম্বোডিয়া—দুই দেশের সরকারই এখন পর্যন্ত এই প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করেছে। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এটিকে ‘বানানো গল্প’ এবং ‘ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ১৯৯১ সালে সম্পাদিত প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কম্বোডিয়ায় বিদেশি সামরিক ঘাঁটি বানানোর অনুমতি দেওয়া অবৈধ। এ ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও উল্লেখ করেছে, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার বিষয়ে দেশটি তার জনগণের কাছে সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তবে বাস্তবতা হলো, হুন সেনের এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের একটি কারণ আছে। তা হলো, তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদ আঁকড়ে ধরে থাকা একজন কর্তৃত্ববাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার নেতৃত্ব নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল খুবই হতাশ। দেশটিতে যেভাবে সরকারবিরোধী জনমত জোরালো হয়ে উঠেছে, তা হুন সেনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিমূলক।

গত বছরের নির্বাচনের আগে আমার নেতৃত্বাধীন দল কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর যে পাতানো নির্বাচন হয়, তাতে হুন সেনের কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি পার্লামেন্টের সবগুলো আসনে জয়ী হয়।

হুন সেন ভালো করে জানেন, চীনের মদদপুষ্ট হওয়ার সুবাদে তিনি দেশের ভেতরকার বিরুদ্ধশক্তির রোষানল থেকে রক্ষা পাবেন। এটি হিসাব করেই তিনি বুঝেছেন, কম্বোডিয়ার জনসমর্থনের চেয়ে চীনের সমর্থন তঁার সরকারের জন্য বেশি দরকারি। দেশটিতে চীনের যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক উপস্থিতি, শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত সম্প্রদায়ই তার সুফল ভোগ করে। নিজের গদি বাঁচাতে হুন সেন ‘ঠ্যাকনা’ হিসেবে যে পথ অনুসরণ করছেন, তার জন্য শুধু কম্বোডিয়ার মানুষকেই নয়, আশপাশের দেশের মানুষকেও বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে।

রিয়াম নৌঘাঁটিতে চেপে বসতে পারলে চীনের পক্ষে আশপাশের দেশগুলোকে ভয়ভীতি দেখানো এমনকি সেখানে আক্রমণ করা সহজ হবে। এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে যে বিতর্কিত দ্বীপগুলোর মালিকানা চীন দাবি করে আসছে, সেই দাবিকে সে আরও পোক্ত করার সুযোগ পাবে।

বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের পথের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেড়ে গেলে তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য অনিবার্য হুমকি হয়ে উঠবে।

গ্রিস, ইসরায়েল, ইতালি এবং হর্ন অব আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করে চীন বৈশ্বিক নৌ মহাশক্তি হওয়ার যে চেষ্টা করছে, দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বাড়াতে পারলে তার সেই চেষ্টা বহুদূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

চীন বিদেশে প্রথমবারের মতো জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করেছে। এই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণ করার জন্যই তারা এখানে ঘাঁটি বসিয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের চারপাশে চীন সামরিক বলয় (যেটিকে অনেকে ‘আয়রন কার্টেইন’ বা ‘লৌহ পর্দা’ বলে আখ্যায়িত করেন) তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। কম্বোডিয়ায় শেষ পর্যন্ত চীন সামরিক ঘাঁটি করলে তার সেই লক্ষ্য অনেকটাই পূরণ হয়ে যাবে এবং গোটা এলাকা চীনের হাতের মুঠোয় চলে আসবে।

পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভানুয়াতুতে গভীর সমুদ্রবন্দর করার সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এসব জায়গায় চীন তাঁর নৌ উপস্থিতি বাড়িয়ে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পশ্চিমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারে। আর ইতিমধ্যেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জালে জড়িয়ে তিনটি দেশকেই সমুদ্রবন্দর দিতে বাধ্য করার অবস্থায় নিয়ে গেছে চীন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্যাম রেইনসি : কম্বোডিয়ার প্রধান বিরোধী দল কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান