খাদিজাদের জীবন তো ঝুলেই আছে কিনারে

১৫ তলা ভবনের দশম তলার বারান্দার বাইরে গ্রিল ধরে ঝুলে আছে খাদিজা। গ্রিলের দরজাটি তখন ছিল তালাবদ্ধ। সার্কিট হাউস সড়ক, রমনা, ঢাকা, ৩০ জুলাই। ছবি: আবদুস সালাম
১৫ তলা ভবনের দশম তলার বারান্দার বাইরে গ্রিল ধরে ঝুলে আছে খাদিজা। গ্রিলের দরজাটি তখন ছিল তালাবদ্ধ। সার্কিট হাউস সড়ক, রমনা, ঢাকা, ৩০ জুলাই। ছবি: আবদুস সালাম

খাদিজা ঝুলছিল। তার এই ঝুলে থাকা মিনিট কয়েকের জন্য আশপাশের পথচারীর জীবন থমকে দিয়েছিল। তাঁরা দেখছেন, ১৫ তলা ভবনের দশম তলার বারান্দার বাইরে ঝুলে আছে একটি মেয়ে। বুকের ভেতরকার ধুকধুকানি নিয়েই তাঁরা চিৎকার করেছেন। তাঁদের কাছে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি মেয়েটি পড়ে গেল! কারণ খাদিজার হাতটি গ্রিলের সঙ্গে সামান্য লেগেছিল। এই রকম দৃশ্য দেখাও ভয়ংকর কষ্টের।

কিন্তু যে বাসায় মেয়েটি কাজ করত সেই বাসার গৃহকর্ত্রী ছিলেন চিন্তাহীন। তিনি খাদিজার কার্নিশে পড়ে যাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের হইচই করেননি, তাকে উদ্ধারের জন্য কারও কাছি আরজি পেশ করেননি। এমনকি একটু এদিক-ওদিক হলেই একজন মানুষের জীবন মুহূর্তেই নিভে যেতে পারে জেনেও তিনি মেয়েটিকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করেননি। বরং তিনি মেয়েটির জীবনের নিরাপত্তার চেয়েও বাইরের ভিড়ভাট্টা নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, তিনি বারান্দায় একটু পরপর আসা-যাওয়া করছেন। এ অবস্থায়ই মেয়েটিকে উদ্ধার না করে বকাঝকা করছেন। কিন্তু তিনি মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য তালা খুলছিলেন না। যখন আশপাশের লোকের ভিড় বড় হয়, লোকজন মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন, একপর্যায়ে পুলিশ এলে তিনি বারান্দার গ্রিলের তালা খুলে দেন।

গৃহকর্ত্রীর দাবি, দুজন গৃহকর্মীর মধ্যে ঝগড়া হয় এবং ঝগড়ার একপর্যায়ে খাদিজা বারান্দার বেষ্টনীর ফোকর গলে বাইরে ঝুলে থাকে। কথার খাতিরে আমরা ধরে নিই, খাদিজা নিজ থেকেই সেই মরণফাঁদে চলে গিয়েছিল। গৃহকর্ত্রী কোনোভাবেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু এর পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণে আমরা কী দেখতে পাই? পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে আমরা দেখতে পাই, গৃহকর্মী যখন কার্নিশে ঝুলছিল, তখন গৃহকর্ত্রী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছেন এবং মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছেন। গৃহকর্ত্রী হিসেবেই নয়, যে কেউই যদি প্রথম জানতে পারেন একজন মানুষ এই রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কী করা উচিত ছিল তাঁর? নিশ্চয়ই তিনি তাকে তিনি উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। তিনি না পারলে অন্যের সহযোগিতা চাইবেন, কিংবা সহযোগিতার জন্য সরকারের বিভিন্ন বাহিনীকে অনুরোধ করবেন। কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই করেননি।


উল্টো মেয়েটি যখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গ্রিলে ঝুলছিল, তখন ওই ‘মানবাধিকার’ নেত্রী নিজে ভেতর থেকে গ্রিলের দরজায় তালা মেরে দেন। কারণ, মেয়েটি তাঁর বাসায় কাজ করে, তিনি মেয়েটির মনিব এবং তাঁর কাছে সেই গৃহকর্ত্রীর জীবনের কোনো দাম নেই। কারণ, সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে আমাদের সবার জীবন এক রকম গুরুত্বপূর্ণ নয়, সব জীবনের দামও এক নয়। এ শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের এই দম্ভ ‘সঠিকভাবেই’ মাথায় গুঁজে দিয়েছে। তাই এ দেশে সস্তা জীবনের মূল্য ‘সস্তা’ লোকদের কাছেই দামি। রাস্তার সাধারণ লোকজনই পুলিশকে খবর দেয়।

গৃহকর্ত্রীর খাদিজার প্রতি ক্ষোভ সহজেই মিলিয়ে যায় না। সবার সামনেই তিনি তাঁর ‘মর্যাদা’ নষ্ট করার অভিযোগে খাদিজাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। খাদিজাকে উদ্ধারের দায়িত্ব এড়িয়ে খাদিজা হয়ে ওঠেন তাঁর মর্যাদাহানির কারণ। এর পরবর্তী সময় তা শ্রেণি দম্ভ আরও পোক্তভাবে হাজির হয় যখন পুলিশ কর্মকর্তা খাদিজাকে সোফায় বসতে বললে গৃহকর্ত্রী লাভলী রহমান বাধা দিয়ে বলেন, ‘ও আমার চাকর ও কেন বসবে! ও দাঁড়িয়েই থাকবে।’ এবং খাদিজা সেখানে না বসে মাথা নত করে দাঁড়িয়েই থাকে। খাদিজার মাথা নিচু করে থাকা আমাদের বিষয়টির মীমাংসা করায় না, খাদিজার দোষ স্বীকারের আরজিকে ইঙ্গিত করায় না, বরং আভাস দেয় অন্য কিছুর, যা হয়তো পুলিশি জেরায় বের হয়ে আসে না।

গৃহকর্মীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের খবর আমরা কম-বেশি পাই পত্রিকার মাধ্যমে, তবে সেটিও পত্রিকার পাতায় জায়গা পায় যখন গৃহস্থালির মধ্যে জারি থাকা নিপীড়ন সেই মেয়ে বা ছেলে গৃহকর্মীর মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে। এর বাইরে চড়, থাপ্পড়, প্রহার, বকাঝকা ও নানা ধরনের মৌখিক হেনস্তা এখন পর্যন্ত সমাজ এবং রাষ্ট্রের ‘বৈধতা’ নিয়েই সহনীয় হয়ে আছে।

কার্নিশে ঝুলে পড়া মেয়েটি ভয় পেয়েছে। এই ভয় মৃত্যুভয় নয়, এই ভয় তার মনিবের ভয়। আরও কী কী ধরনের সম্ভাব্য নিপীড়নের শিকার মেয়েটি হতে পারে, সেটির ভয়। যে কারণে মেয়েটি কারও কাছে মুখ খোলেনি। মাথা নিচু করেই ছিল। এই ভয়, হাজারো বকাঝকা এবং হেনস্তা ও বৈষম্যে মোড়া তার ১৫ বছরের জীবনটিকে নিয়ে। শুধু সে নিজে নয়, সে জেনে গেছে তার ‘মানবাধিকার’ নেত্রী পরিচয়ধারী মনিব তার পরিবারকেও হেনস্তা করবে, তার মা-বাবাকে শাসাবে।

তবে গৃহকর্মীর ওপর চর্চিত অন্য নিপীড়নগুলোর সঙ্গে এই নিপীড়নের পার্থক্য আছে। প্রচলিত ধরনের নিপীড়নের রাস্তায় হাঁটেননি এই ‘মানবাধিকার’ নেত্রী। নিপীড়নের ভিন্ন ধরনের কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন। দোষ চাপিয়েছেন দুই ক্ষমতাহীন গৃহকর্মীর ওপর। কারণ তিনি জানেন, তার বাড়তি নিপীড়নের ভয়ে তারা চুপ থাকবে। ছোট্ট জীবনগুলোকে রক্ষা করে একটু বেঁচে থাকার আশায় তাদের চুপ থাকতে হয়। কাজে লাগিয়েছেন তিনি গাড়ি চালককেও। পরদিন তাঁর গাড়িচালকও থানায় গিয়ে বলে এসেছেন, তাঁর মনিব ‘কত্ত ভালো’!

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি কুকুর কিংবা ছোট ছোট প্রাণীও যদি কোনো গর্তে পড়ে যায়, তাকে সেখান থেকে তুলে আনার জন্য বহু মানুষ এগিয়ে যায়। প্রয়োজনবোধে ডেকে নিয়ে আসে বিভিন্ন সংস্থাকে। আর আমাদের দেশে আমরা অনেক মানুষকেই এগিয়ে দিই মৃত্যুর দিকে। কারণ তাদের অপরাধ, তারা অন্যদের শ্রেণি দম্ভকে হয়তো কোনো না কোনো ভাবে আঘাত দেয়?

পুলিশ বলছে, খাদিজা অন্য গৃহকর্মীর সঙ্গে ঝগড়া করেই সেখানে গিয়েছিল? কিন্তু খাদিজার মনিব কেন তাকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখালেন? সেই ঢিলেমির পেছনের কারণ কী খুঁজছে পুলিশ বাহিনী? নাকি সব দোষই ‘ছোটলোকদের’। ওরা ওদের সীমা লঙ্ঘন করে বলে দু-চার ঘা দিতেই হয়—এই বেদবাক্য জপে মামলা ডিসমিস করে ‘বড়লোকদের’ জয়গান গাওয়াই আমাদের যাপিত জীবনের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে?