বিশ্বাসে মিলায় ডেঙ্গু...

ডেঙ্গু জ্বরে ১৫ দিন ধরে ভুগছে ছয় বছরের শিশু মুশনান। হাসপাতালের মশারিঘেরা বিছানাটিই তার এখন পুরো জগৎ। আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। পায়ে ছবি এঁকে সময় কাটাচ্ছে সে। সম্প্রতি শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে। ফাইল ছবি
ডেঙ্গু জ্বরে ১৫ দিন ধরে ভুগছে ছয় বছরের শিশু মুশনান। হাসপাতালের মশারিঘেরা বিছানাটিই তার এখন পুরো জগৎ। আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। পায়ে ছবি এঁকে সময় কাটাচ্ছে সে। সম্প্রতি শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে। ফাইল ছবি

বিশ্বাস এমন একটি জিনিস, যা কেউ হারাতে চায় না। আমরাও বিশ্বাস করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বিশ্বাস শুধু টলে যায়নি, বরং ধুয়েমুছে সাফ হওয়ার জোগাড়। বিশ্বাস স্থাপন করে এখন আর কাঙ্ক্ষিত কিছু মিলছে না, মিলছে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা।

ঢাকা শহরে ডেঙ্গু প্রথম এসেছিল একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। আমরা হয়তো বিশ্বাস করেছিলাম যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এত বছরে ডেঙ্গু ঠেকাতে কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এটি ঠিক, অঙ্ক কষে কখনো রোগ নির্মূল করা যায় না। অনেক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকির কারণে এটি সম্ভব হয় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু সেই কাজটিও যে করা হয়নি, তা এ বছর পরিষ্কার। তাই ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ছেলেকে দাফন করে এসেই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত মেয়ের পাশে উদ্বেগে দিন কাটাতে হচ্ছে মা–বাবাকে। ঢাকা ও এর আশপাশে শুরু হয়েছে রক্ত খোঁজার হুড়োহুড়ি। হাসপাতালে লাইনও বড্ড লম্বা। কেউ যাচ্ছেন জীবন বাঁচাতে, কেউ যাচ্ছেন জীবন ঝুঁকিতে আছে কি না, জানতে।

অথচ শুরুতে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেছিলেন, সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন ‘ছেলেধরার মতো গুজব’। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়েও তাঁর আপত্তি ছিল। তা থাকতেই পারে। তাঁর কথার সারমর্ম ছিল, ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপে দেখা দেয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথার সুরও তেমনি ছিল। এই কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেই আছে। বিভ্রান্ত আমরা ক্ষুব্ধ মনে হয়তো কিছুটা মেনেও নিয়েছিলাম। ধন্দে থাকা স্বাভাবিক, সরকারের মাথারা কি আর ভুল বকবেন? অথচ এর কিছুদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ল দেশের প্রায় সব জেলাতে। নিজের পরিচিতদের মধ্যেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর কানে এল। এক নিকটজন ডেঙ্গু জ্বরে হাসপাতালে গেলেন। মানসিক ঝড়ঝাপটা ফের জানিয়ে গেল, ডেঙ্গু হওয়ার জ্বালা কেমন! দুই-তিন বছর ধরেই ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার মশার কামড়ের ‘তাৎপর্য’ বোঝার অভিজ্ঞতা হচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখা তাই এভারেস্ট জয়ের চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে মশারি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে নিজেই মশারি গায়ে জড়িয়ে অভিনব প্রচারণায় নেমেছেন মমিনুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে মশারি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে নিজেই মশারি গায়ে জড়িয়ে অভিনব প্রচারণায় নেমেছেন মমিনুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আতঙ্ক বড়ই সংক্রামক। সাধারণ জ্বরও এখন ডেঙ্গু মনে হচ্ছে। ভিড় বাড়ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সবাই জানতে চাইছেন, রক্তে ডেঙ্গুর বীজ আছে কি নেই। প্রথম দিকে আমাদের বিশ্বাস ছিল, পরীক্ষার ফি নিশ্চয়ই খুব বেশি নেওয়া হচ্ছে না। তবে সেই বিশ্বাসও ভেঙেচুরে একাকার। আদালত যে মূল্য নির্ধারণ করেছেন, তার সঙ্গে আগের মূল্যের তফাত অনেক। এখন আবার ডেঙ্গু পরীক্ষার উপকরণ বা কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউরোপ ও কোরিয়ায় তৈরি ভালো মানের যে কিট ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি এখন ৫০০ টাকায় উঠেছে। চীনের তৈরি ১৫০ টাকার কিট বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। এই দেশে সব সমস্যার সমাধান হয় ভোক্তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে। এবার তার ব্যতিক্রম হবে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। অর্থাৎ শান্তিমতো একটু রক্ত পরীক্ষা করারও জো নেই।

আবার ব্যক্তিগতভাবে যে মশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন, তাতেও টাকার থলে যথেষ্ট পরিমাণ হালকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাড়ছে মশা তাড়ানোর ‘অস্ত্রে’র দাম। মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করেন অনেকে। এসবের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এবার মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রথমত, এগুলো বাজারে সার্চলাইট জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যদি পাওয়াও যায়, তবে দাম জানতে গিয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা। বিক্রেতাদের অকাট্য যুক্তি—‘মার্কেট আউট’। এক বন্ধুর কাছ থেকে জানলাম, গায়ে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের দ্বিগুণ দামে পণ্য কিনতে হয়েছে তাঁকে। বিশ্বাস হচ্ছিল না। সরেজমিনে দেখলাম, একটি কোম্পানির তৈরি ৯৯ টাকার মশা তাড়ানোর লোশন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। কেনার পর পণ্যের গায়ে লেখা দামের স্টিকারের দিকে তাকালে কেমন যেন লাগে! কিছুটা রাগ, অনেকটা অসহায়ত্ব আর সর্বগ্রাসী আতঙ্কের এক ঘুঁটা। এ দেশে জীবনের চেয়ে ব্যবসার দাম বেড়েছে অনেক দিন আগে। জানা বিষয়টাই চোখের সামনে নাঙ্গা হয়ে গেলে খুব অস্বস্তি লাগে।

তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে শিশু ফাতেমা। ডেঙ্গু কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন দেখে মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে জরুরি বিভাগে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছেন। শনিবার রাজধানীর শিশু হাসপাতালে।  ছবি: সাজিদ হোসেন
তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে শিশু ফাতেমা। ডেঙ্গু কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন দেখে মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে জরুরি বিভাগে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছেন। শনিবার রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। ছবি: সাজিদ হোসেন

স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো বলছেন, ডেঙ্গু মহামারি আকার নেয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মৃতদেহের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আতঙ্কের বানে বাঁধ দিতে পারছে না। তিন-চার দিনের জ্বরে ফুটফুটে শিশুদের অকালে ঝরে যাওয়ার খবর শুনলে আতঙ্ক কীভাবে কমবে? তা–ও যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সরকারি কর্মকাণ্ড চোখের সামনে নিয়মিত মূর্ত হতো, তবে হয়তো তা স্বস্তি জাগাতে পারত। কিন্তু দিন শেষে আশ্বাস আর জনগণের মনে বিশ্বাস জাগাতে পারছে না। কারণ, বিশ্বাস করে বারবার ঠকে যাওয়ার বেদনা বড্ড তীব্র। ক্রমাগত একই ঘটনা ঘটলে একসময় বিশ্বাসের ভিত ভেঙে বিশ্বাসহীনতার প্রবণতা জন্ম নিতে পারে। আমাদের না আবার গণহারে পিসটানথ্রোফোবিয়া হয়ে যায়! এটি একধরনের মানসিক রোগ। এই রোগে কাউকে বিশ্বাস করতে বা কারও ওপর আস্থা রাখতে ভয় হয়।

কবিগুরু বলেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। পাপের ভাগী না হয়ে চলুন বরং আশায় থাকি, ফের বিশ্বাস করি। একদিন হয়তো উড়োজাহাজে চেপে মশা তাড়ানোর কার্যকর ওষুধ আসবে, হয়তো তা ঠিকমতো ছিটানো হবে, হয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে, হয়তো এবারের ঈদের ছুটিতে ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর রূপ নেবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ভুলবেন না, বিশ্বাসে মিলায় —। চিন্তার কিছু নেই। শূন্যস্থানে বসানোর মতো অনেক শব্দ আছে। ডেঙ্গু, ভোগান্তি, মৃত্যু—আরও কত–কী!

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]