চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতির সমস্যা

প্রায় তিন বছর আগে, ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় খবর বেরিয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর এক বছরে ১১ ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ১০০টি সেরা সমুদ্রবন্দরের তালিকায় ৭৬তম স্থান অর্জন করেছে। প্রতিবছর এই তালিকা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল-বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সাপ্তাহিক প্রকাশনা লয়েড’স লিস্ট। তারা বন্দরগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের এই তালিকা তৈরি করে বছরপ্রতি কনটেইনার পরিবহনের হিসাবের ভিত্তিতে। 

গত শনিবার খবর বেরিয়েছে, গত তিন বছরে চট্টগ্রাম বন্দর আরও ১২ ধাপ এগিয়ে ৬৪তম অবস্থানে উঠেছে। এভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এক দশকে বন্দরটির অবস্থান মোট ৩১ ধাপ এগিয়েছে। যদিও এর মধ্যে কোনো কোনো বছর এক ধাপ করে পিছিয়েছিল, তবু চার বছর ধরে ধারাবাহিক অগ্রগতি বজায় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা কমেছে; ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০০টি বন্দরে তালিকার অন্তর্ভুক্ত ৩৬টি বন্দরে কনটেইনার পরিবহন কমে গেছে। কিন্তু আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যতিক্রম, এর ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে।

এটা নিশ্চয়ই একটা প্রীতিকর তথ্য। কেননা, কোনো দেশের আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদন, শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্য। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পুরোটাই বিদেশে যায় কনটেইনারের মাধ্যমে; শিল্প খাতের কাঁচামালসহ আমদানি খাতের বড় অংশও আসে কনটেইনারের মাধ্যমেই। বিশ্ববাজারে ধীরগতি সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের এই অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

তবে এই ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যাও বাড়ছে। লয়েড’স লিস্ট যথার্থ মন্তব্যই করেছে যে চট্টগ্রাম বন্দর নিজের সাফল্যের ‘শিকার’। কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়ার কারণে বন্দরটিতে পণ্য খালাসে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বেশি। সেখানে জাহাজের জট একটা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের যেসব দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে, চট্টগ্রাম বন্দর সেগুলোর তালিকার শুরুর দিকে রয়েছে। 

এ বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে বলা হয়েছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশের মধ্যে সমুদ্রবন্দরে আমদানি পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে পাকিস্তানে (১৬.৬ দিন)। দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর, সেখানে সময় লাগে ১৫.৮ দিন। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, সেখানে নানা সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়েছে, তার ফলে গত বছরের নভেম্বরে জাহাজজটের নিরসন ঘটেছিল। এখনকার জাহাজজটের কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এটা শুরু হয়েছে গত মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে। আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন বন্দরে জাহাজ জেটিতে ভেড়াসহ পণ্য খালাসের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমদানিকারকের পণ্য বুঝে পেতে গড়ে ন্যূনতম ১২ দিন লেগে যাচ্ছে। দেশের আমদানিকারকেরা আশঙ্কা করছেন, আসন্ন ঈদুল আজহার ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের জট আরও বেড়ে যেতে পারে। 

আসলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি অবকাঠামোগত। জেটির সংখ্যা না বাড়ালে দ্রুত পণ্য খালাসের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সমস্যা স্থায়ীভাবে দূর করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ কাজ; অন্তত আরও দেড় বছরের আগে জেটির সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সে জন্য বন্দরের জাহাজজট ও পণ্য খালাসের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চারের উদ্যোগ ফেলে রাখা যায় না। বন্দরের সংস্কার কার্যক্রম নিয়মিত চালাতে হবে, কনটেইনার রাখার জায়গা বা ইয়ার্ড সম্প্রসারণ করতে হবে এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা জোরালো করতে হবে।