আসামের এনআরসি: বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে

নাগরিকত্বের তালিকা প্রস্তুতের এই বিশাল দজ্ঞযজ্ঞ অনেকটাই জোড়াতালি দিয়ে করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই
নাগরিকত্বের তালিকা প্রস্তুতের এই বিশাল দজ্ঞযজ্ঞ অনেকটাই জোড়াতালি দিয়ে করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই

ভারতের আসামে গত বছরের ৩০ জুলাই নাগরিকত্ব নির্ধারণের যে খসড়া তালিকা (এনআরসি) প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে আসামে বসবাসরত প্রায় ৪০ লাখ নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়ে। নাগরিকত্বের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তি বা বাদ পড়ার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যক্তিকে আবেদন জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যার সর্বশেষ সময়সীমা ছিল গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। বাদ পড়া প্রায় ৪০ লাখ লোকের মধ্যে অধিকাংশই পুনর্বিবেচনার আবেদন জানায়। তবে সেখান থেকেও প্রায় চার লাখ লোক কোনো আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় নিশ্চিতভাবেই রয়ে যাচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো বলছে, ৩১ ডিসেম্বরের ঠিক আগে আগে তড়িঘড়ি করে অন্তত ২ লাখ ব্যক্তির খসড়া তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আবেদন জমা পড়ে। বলা হচ্ছে, অধিকাংশ আবেদনই করা হয়েছে অসমীয় জাতীয়তাবাদী দলগুলোর পক্ষ থেকে এবং আসামের বাংলাভাষী, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘু অধিবাসীদের লক্ষ্য করে। এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারি সূত্রমতে এই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে, যা ১৫ জুন নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। অর্থাৎ, এই পুরো যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র চার মাস। এই যাচাই-প্রক্রিয়ার ফলে এই জুন মাসেই আরও একটি তালিকা প্রস্তুত হয়, যাতে নতুন করে আরও প্রায় এক লাখ লোক বাদ পড়ে; যারা কিনা প্রথম খসড়ায় নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

ভারতের কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদনে উদ্বেগ জানানো হয়েছে যে এই আপত্তির আবেদনগুলো হয়রানিমূলক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আবেদনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি জমা দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া এত কম সময়ে কী করে এত লাখ অন্তর্ভুক্তির আবেদন যাচাই-বাছাই সম্ভব, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নাগরিকত্বের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩১ জুলাই, যা সম্প্রতি উদ্ভূত বন্যা পরিস্থিতিতে এনআরসি কো-অর্ডিনেটরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও এক মাস পিছিয়ে ৩১ আগস্ট করা হয়েছে। এর মধ্যেই নতুন অন্তর্ভুক্ত প্রায় এক লাখ মানুষের আবেদনও যাচাই-বাছাই করা হবে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ২৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের যে শুনানিতে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পেছানোর সিদ্ধান্ত হলো, সেই একই শুনানিতে খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ২০ শতাংশ নাম দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় ফের খতিয়ে দেখার আবেদন করেছিল আসাম ও কেন্দ্র সরকার। আবেদনে বলা হয়েছিল, তালিকায় অনেক নামই ভুলবশত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে আসামের বাংলাদেশ-সংলগ্ন জেলাগুলোতে। অর্থাৎ, খোদ সরকারপক্ষই মনে করছে, তালিকা প্রস্তুতে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে এবং সম্ভবত আরও অনেককেই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেত। আবেদনটি আদালত খারিজ করে দিয়েছেন এবং কারণ হিসেবে বলা হয়েছে আসামের এনআরসি কো-অর্ডিনেটরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইতিমধ্যেই তালিকায় ওঠা প্রায় ২৭ শতাংশ নাম ফের খতিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছে। তবে ভারতের মিডিয়ার রিপোর্টগুলো অনুযায়ী, এই ২৭ শতাংশের পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ আসামের বিজেপি পার্টিই। 

জাতিসংঘের কয়েকজন বিশেষ প্রতিনিধির পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সরকার বরাবর প্রেরিত একটি লিখিত বিবৃতিতে এই পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে এর অসামঞ্জস্যতা নিয়েও কড়াকড়ি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সার্বিকভাবে নাগরিকত্বের তালিকা প্রস্তুতের এই বিশাল দক্ষযজ্ঞ অনেকটাই জোড়াতালি দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা প্রক্রিয়াটিকে অসমীয় জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে আসামের ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠীকে সব রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তবে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভাজন এবং এর থেকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ যে শুধু ভারতের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেটি বুঝতে তেমন একটা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন হয় না। এতসংখ্যক মানুষকে একসঙ্গে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিতকরণের প্রক্রিয়াটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের।

গত বছরের জুলাইয়ে অবশ্য এই অস্বাভাবিক নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর উদ্বেগ জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। বলা হয়েছে, আসামের তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা কেউই বাংলাদেশি নন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে কোনো বার্তা আদান-প্রদান হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই; এটি ভারতের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। সংবাদমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে যে বিষয়টি একেবারেই ভারতের নিজস্ব একটি প্রক্রিয়া এবং ভারতীয় সরকারপ্রধান নিজেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছেন যে তালিকা থেকে বাদ পড়া আসামের জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা ভাবছে না ভারত।

এই অনানুষ্ঠানিক মতামত আদান-প্রদান, মিডিয়াকে দেওয়া সরকারি ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার এবং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত—এই সবকিছুই কিন্তু ভারতের সদ্য সম্পন্ন নির্বাচনের আগের প্রেক্ষাপট। স্পষ্ট করে কোথাও না বলা হলেও বাংলাদেশের জন্য পরোক্ষভাবে একটি স্বস্তি কাজ করছিল যে নাগরিকত্বের তালিকা প্রস্তুতের প্রক্রিয়াটি সম্ভবত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি সরকারের ভোট সংগ্রহের একটি রাজনৈতিক চালমাত্র। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় আসামে তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের বিষয়টিকে যেভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল এবং নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের পর নাগরিকত্বের তালিকা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আর যা-ই হোক, এই তালিকা প্রস্তুত যে নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ফাঁকা বুলি নয়, সেটি নিশ্চিত; বরং এটি একটি সুদূরপ্রসারী এবং পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন বলেই ধরে নেওয়া যায়। এমনকি বিজেপির এবারের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রক্রিয়াটিকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ভবিষ্যতে প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি তাহলে কিছু অনানুষ্ঠানিক বার্তার ওপর নির্ভর করে আশ্বস্ত হবে যে প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু? প্রাথমিকভাবে আশা করা যায়, অন্তত ৪০ লাখ বা তার বেশি নাগরিককে রাতারাতি দেশ থেকে বিতাড়নের পরিকল্পনা করবে না ভারত। ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সুসম্পর্কের কথা মাথায় রেখে বারবার এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আপিল করার সুযোগ থাকবে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। তারপর আবার আপিল করা যাবে হাইকোর্টে এবং সর্বশেষে সুপ্রিম কোর্টে। অর্থাৎ, কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলেও ভারতের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে এই বলে যে পুরো প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার এবং এ কারণে ভারত থেকে কাউকে শিগগিরই ফেরত পাঠানো হবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই।

তবে প্রশ্ন হলো, এই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় যে লক্ষাধিক প্রান্তিক লোক অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের সব রাজনৈতিক অধিকার হারাবে এবং সবশেষে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসেবে হয়তো যাদের স্থান হবে কোনো বন্দিশিবিরে, তারা এই অন্যায় মেনে নিয়ে এবং অধিকারবঞ্চিত হয়ে কতটা নিরাপদ মনে করবে আসামকে? নাগরিকত্ব হরণের প্রক্রিয়াটি যে রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠী তৈরি করবে, তারা যে আসামে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষের শিকার হয়ে নিগৃহীত হবে না বা অন্তত নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা করবে না, তেমনটা বলা যাচ্ছে না। এই নিগৃহীত হওয়ার ভীতি থেকেই অন্য রাষ্ট্রের সীমানায় আশ্রয় চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করবে অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হয় এমন করেই। আসামের নাগরিকত্বের তালিকা প্রস্তুতের এই প্রক্রিয়া যেভাবে একটি বিপজ্জনক মেরুকরণ করছে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে, তাতে বাংলাদেশের জন্য আগামী বছরগুলোয় ভারতীয় শরণার্থী সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকট।

তা ছাড়া নাগরিকত্বের তালিকা নিয়ে আসামে সব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে সব সময়ই ছিল তথাকথিত ‘বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা’। ফেরত পাঠানো উচিত কি অনুচিত, এই বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারতে অনেকেই মনে করেন, এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশ থেকেই সেখানে গেছে। খোদ সুপ্রিম কোর্টের যে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে, সেই সিদ্ধান্তেই আসামের অবৈধ অধিবাসীদের বাংলাদেশেই ফেরত পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। তাই এই পুরো প্রক্রিয়াকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ ধরে নিয়ে চিন্তামুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

শরণার্থী সংকটের বাইরেও এই বিভাজনমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি আসামে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার যে নতুন মাত্রা যোগ করবে, তা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কতটা আঘাত হানবে, সেটিও ভেবে দেখা প্রয়োজন। ৩১ আগস্টের চূড়ান্ত নাগরিকত্বের তালিকা প্রকাশ সামনে রেখে তাই বাংলাদেশের সঠিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নির্ণয় করা অতি জরুরি।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক