সদা কর্মচঞ্চল মানুষটি

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিচয় ষাট বছরের কম হবে না। আমরা প্রাইমারি পড়েছি সেকালের এমই স্কুলে, এখন যেটি চট্টগ্রাম সরকারি হাইস্কুল নামে পরিচিত।  সেখানে আমি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৫৭ সালে। তাদের ভাই আয়ুব ছিল আমাদের সহপাঠী। জাহাঙ্গীর আমার জুনিয়র, ১৯৫৮ কি ৫৯, ইংরেজিতে সে আর তার পিঠাপিঠি বড় ভাই আযম সম্ভবত ভর্তি হয়েছিল একই ক্লাসে। সেই থেকে চিনি তাদের। এক প্রাইমারি, এক হাই, এক কলেজ এবং শেষে এক বিশ্ববিদ্যালয়। এমএ শেষ করে আমি চট্টগ্রাম ফিরে আসি ১৯৭৩ সালে, জাহাঙ্গীরের তখনো এম এ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন মহসিন হলে আমার রুমেই থেকেছে সে। জাহাঙ্গীরের মেজ ভাই আর আমাদের ইউনূস ভাই আমেরিকা থেকে ফিরে দু–এক রাত এখানে ছিলেন। তখন আমি সূর্যসেন হলে আরেক বন্ধুর কক্ষে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই জাহাঙ্গীর সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান–এর (স্বাধীনতার পরে দৈনিক বাংলা, অধুনা বিলুপ্ত) বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে। তখন পত্রিকাটি ছিল তারকাখচিত কাগজ—সাংবাদিকতা ও সাহিত্যাঙ্গনের বাছাই মানুষদের নিয়ে আইয়ুব সরকারের দৈনিক পত্রিকা। সরকারি কাগজ হলেও এর কর্মীদের ব্যক্তিগত ভূমিকা ও ভাবমূর্তির কারণে আইয়ুববিরোধী এই অঞ্চলেও ওই জাগরণের সময় পত্রিকাটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় বিশিষ্টই ছিল। প্রথম পেশাই তার জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছিল। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর শেষ অবধি গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত হয়েছে। সে অবশ্য আরও পরের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে ঢাকাই তার আবাস হয়েছে।

জাহাঙ্গীরের কথা মনে করলে প্রথমেই তার হাসির কথা মনে আসে আর হাসিতে উদ্ভাসিত মুখটা ভেসে ওঠে স্মৃতির পটে। নোবেলজয়ী ইউনূস ভাইসহ তারা সব ভাই-ই রসিকতা করে কথা বলতে অভ্যস্ত। ফলে দেখা হতেই যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি হতো। কিন্তু তা বলে সর্বক্ষণ যে রঙ্গ-রসিকতায় কাটত তা নয়, জাহাঙ্গীর আদতে কাজের মানুষ। তাই তার মাথায় নানা কাজের পরিকল্পনা থাকত। তার বড় গুণ ছিল যে কাজে আগ্রহী হতো, সেটা নিয়ে কাজের ছক তৈরি করে নিতে পারত। এ ধরনের যেকোনো আলোচনায় জাহাঙ্গীর তৈরি হয়েই আসত এবং কাজের বিস্তর প্রস্তাব হাজির করত। এসব বাস্তবায়নের জন্য তার পরামর্শেরও কমতি হতো না। কখনো দেখেছি যেচে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে কিছু দায়িত্ব নিতেও চাইত। এটাও বলা দরকার, জাহাঙ্গীর দায়িত্ব নিলে সেটা পালন করত, কখনো কাজ ফেলে রাখত না। তার মধ্যে আলস্য বা জড়তা দেখিনি।

জাহাঙ্গীর কিন্তু তুখোড় মেধাবী ছাত্রও ছিল না। কিন্তু সে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝে তার অনেকটা কাটিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিল। এ দেশে কাউকে তৈরি হতে অন্যরা বিশেষ সাহায্য করে না, সে অর্থে নিজেকে সে নির্মাণ করে নিয়েছিল। ষাটের দশকের তরুণেরা সবাই প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতাম। জাহাঙ্গীরও তা–ই ছিল। তখন পোস্টার হতো হাতের লেখা, আর জাহাঙ্গীরের হস্তাক্ষর ছিল সুছাঁদের। তাই ও পোস্টার তো লিখতই, তখনকার অনেক আমন্ত্রণপত্র, স্মরণিকা, সাময়িকীর নামলিপি তারই হাতের লেখায় হতো। মনে রাখতে হবে, ওই সময় ছিল ছয় দফার পরে বাংলাদেশের জাগরণের কাল। শিক্ষিত সমাজে বাংলা প্রচলন ও তার ব্যবহার বাড়ছে, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীর প্রচলন হয়েছে, বামপন্থীরা তাঁদের সঙ্গে সুকান্তকেও জুড়ে দিচ্ছেন। কবিতা পড়া, বাংলা বই কেনার রেওয়াজ হয়েছে, এমনকি খদ্দরের প্রচলনও বেড়েছে। আমরা দোকানপাট-অফিসের নামফলক, গণপরিবহনের নম্বরপ্লেট বাংলায় লেখার অভিযানেও অংশ নিয়েছি। সে একটা কাল কেটেছে আমাদের! তখনকার সহযাত্রীরা ভিন্ন পেশা, অন্য মত বা স্থানিক দূরত্বকে বাধা মনে করিনি কখনো। যেকোনো সময় দেখা হলেই একই উষ্ণতায় আড্ডায় জমে যেতে পারি। জাহাঙ্গীর চট্টগ্রাম এলেই নিয়ম করে সেই আড্ডার রেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত। কখনো বাসায় এসে আড্ডা দেওয়ার আমন্ত্রণ নিজেই দিত, উপযুক্ত বন্ধুদের খবর দেওয়ার দায়িত্বও পালন করত।

ওই সময়ে মুদ্রণজগতে একটা কালান্তর ঘটছে। একদিকে ছিল সৈয়দ মোহাম্মদ শফির আর্ট প্রেস ও বইঘর, অন্যদিকে ইউনূস ভাইয়ের পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত প্যাকেজেস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন শিল্পী সবিহ-উল আলম, যিনি মুদ্রণকে শিল্পে পৌঁছানোর কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে তালিম নিয়েছে, তাঁর সঙ্গে তাঁর নির্দেশনায় বিস্তর কাজ করেছে। বইঘরের সঙ্গেও তার যোগ ছিল কাজের। এসব কাজকর্মে তার সুছাঁদের লেখা, সহজাত নকশার বোধ এবং বিধিদত্ত কাণ্ডজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজের একটা স্থান করে নিয়েছিল জাহাঙ্গীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তার নিজেকে তৈরি করার ও প্রকাশের ক্ষেত্র বেড়েছিল। ঢাকায় জাহাঙ্গীরের বন্ধুমণ্ডলী বড় হয়েছে, শুভানুধ্যায়ীর পরিসরও বেড়েছে। নিশ্চয় অনেকের কাছেই সে নানা বিষয় শিখেছে। কিন্তু একজন কাউকে গুরু মানেনি, গুরু ধরেনি। নিজের কাজটা নিজেই ঠিক করে নিয়েছে, আর সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।

পত্রিকার চাকরিতে থাকতেই ছাত্রজীবনে সে বিটিভি ও ঢাকা বেতারে নানা বিষয়ে টক শোতে অংশ নিতে শুরু করে, নিজে উপস্থাপনাও করেছে সফলভাবে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও টিএসসিকে ঘিরে নাটক, আবৃত্তি, সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে তারুণ্যের ঝলক নিয়ে একঝাঁক প্রতিভাবান তরুণের আবির্ভাব ঘটেছিল। জাহাঙ্গীর নিজে সরাসরি এসব কলাচর্চায় যুক্ত না হলেও তার জনসংযোগ এবং নানা বিষয়ে পরামর্শের ক্ষমতার গুণে সে-ও এ বৃত্তেরই একজন ছিল। তখন থেকে তার কাজ হয়ে ওঠে নানা বিষয়ে গণমাধ্যমে লেখায় ও বলায় হাজির হওয়া। সে কাজে নিজের সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে সে। চাকরি ছেড়ে একসময় গণমাধ্যম নিয়ে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান গড়ে কাজ করেছে।

আমি যখন ঢাকার একটি পত্রিকায় উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব নিই, তখন ইনহাউস প্রশিক্ষণের জন্য তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার সলাপরামর্শ করেছি। তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেই রাজি হয়েছিল আর পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়ে পত্রিকার কিছু কপি আগে পাঠাতে বলেছিল। তখন ক্যানসারের চিকিৎসার পরে অনেকটা সুস্থ সে, ফলে আমরা দুজনেই খুব আশাবাদী ছিলাম কাজটা নিয়ে। কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরেও তাকে ভীষণ দুর্বল দেখে তখনকার মতো কাজটা আমরা মুলতবি করেছিলাম। সেটা আর শুরু করার মতো অবস্থা হয়নি। জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে শেষ পর্যন্ত একটা কলাম লিখে গেছে। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় গণমাধ্যম, নাগরিক জীবন ও সমাজ নিয়ে তার ভাবনাচিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তাতে বিশ্লেষণের চেয়ে সমাধানের পরামর্শ থাকত বেশি।

জাহাঙ্গীর হয়ে উঠেছিল কাজের মানুষ, যে গণমাধ্যমের সব বিষয় নিয়ে ভাবত। তার ভাবনা ছিল মৌলিক এবং তাতে থাকত প্রচুর পরামর্শ। শেষ দিকের অসুস্থতা তার মতো একজন কর্মী ও সংগঠকের কর্মশক্তি হরণ করেছিল। কিন্তু লক্ষ করেছি, তার কর্মস্পৃহা কখনো স্তিমিত হয়নি। শেষবার সম্ভবত বাংলা একাডেমির এজিএমে দেখা হয়েছিল, মাঠে দাঁড়িয়ে, পরে চায়ের স্টলে বসে আমরা অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলেছি। বলা বাহুল্য, সে আলাপেরও সিংহভাগ জুড়ে ছিল তার স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার কথা। একপর্যায়ে আড্ডা ভঙ্গ করেছি পরস্পরের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে। চিরবিদায়েও স্মৃতিপটে ওর হাসিমুখটাই ধরা আছে—তবে সেই হাসিমুখ, যেটি শৈশব থেকে অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত বজায় ছিল। স্মৃতি সেই উদ্ভাসিত হাসিমুখটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। মনের পটে সেটাই থাকুক চিরভাস্বর হয়ে।


আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক