সবকিছুতেই নারীর অপরাধ খোঁজা

স্কুলজীবনেই পড়েছিলাম, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশীয় গল্প এবং লোককথার সংকলন ‘আরব্য রজনী’, যার মূল নাম ‘এক হাজার এক রাত’। সংকলনটি ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ নামেও পরিচিত। আরব্য রজনীর মূল কাহিনি গড়ে উঠেছিল পারস্যের সম্রাট শাহরিয়ার এবং তার নববধূকে ঘিরে। ভাইয়ের বধূর অবিশ্বস্ততা নাকি সম্রাটকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। পরবর্তী সময়ে তার নিজের স্ত্রীও তাকে প্রতারণা করে এবং সে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরবর্তী সময়ে সে একের পর এক তরুণী বিয়ে করে পরের দিন সকালেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া শুরু করে, যেন তারা আর প্রতারণা করার সুযোগ না পায়। অবশেষে উজিরকন্যা শেহেরজাদের হাজার রাত্রির গল্পের ফাঁদে পড়ে সম্রাট। আগের রাতেই অসমাপ্ত গল্প পরবর্তী রাতে শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে সে ধীরে ধীরে সরে আসে নববধূকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে। 

অ্যারাবিয়ান নাইটস যখন প্রথমবার পড়েছিলাম, তখন মনে প্রশ্ন এসেছিল, সম্রাট কী এমন প্রতারণার শিকার হয়েছিল, যা তাকে এ রকম নারীঘাতক করে তুলেছিল! প্রতারণার তুলনায় মানবহত্যা কি কোনো অংশে কম অপরাধ? আর অপরাধের শোধ তুলতে নিরপরাধ শত শত নারী হত্যার বিষয়টি আমার কিশোর মন কিছুতেই মানতে চাইত না। ইদানীং আমাদের চারপাশে নারীর প্রতি মাত্রাহীন সহিংসতা দেখে কেবলই মনে হয়, সম্রাট শাহরিয়ারের ভূত হয়তো এখনো বিচরণ করছে আমাদের চারপাশে। আজও অনেক ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ না করেও নারী অপরাধী হন, সাজাও পান। নারী নির্যাতনের ঘটনা তো বটেই, সংঘটিত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও তদন্তের আগেই আমাদের সমাজ নারীর সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতে ভালোবাসে। 

আসলে আমরা এখনো এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যেখানে নারীর বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধকে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ বলে মনে করা হয় না। কারণ, মেয়েরা এখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গণ্য হন না অনেকের কাছেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও পুরুষের পক্ষে; তাই তাঁদের অপরাধকে গৌণ করে দেখা হয়। নারী নির্যাতনের মূল হোতা পুরুষ হলেও প্রায় প্রতিটি নির্যাতনের ঘটনায় নারীর ভূমিকাকেই বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। অন্যান্য অপরাধের নেপথ্যেও প্রথমেই বিবেচনায় আনা হয় নারীর সম্পৃক্ততাকে; যেন নারীর উসকানিতেই পুরুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। যা অপরাধ তা অপরাধই। নারীর সম্পৃক্ততার কারণে প্রকৃত অপরাধীর অপরাধ কোনোভাবেই লঘুভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। 

মনে পড়ে, তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তনুর জীবনযাপন নিয়ে। ক্যান্টনমেন্টের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়ের ভেতর ধর্ষণের ঘটনাটি গৌণ হয়ে অনেকের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল তনুর জীবনযাপন। এই প্রয়াসে অনেকে তনু কতটুকু নিয়ম মেনে পর্দা করতেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেননি। যেন এ ধরনের সাজাই প্রাপ্য ছিল তনুর। টাঙ্গাইলে গণপরিবহনে ধর্ষিত হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া রুপাকেও দায়ী করা হয়েছিল তার এই করুণ পরিণতির জন্য। অনেকেই বলেছিল, রাতে একা চলাফেরা করলে তো এমন হবেই। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক নন, বরং ধর্ষণের শিকার মেয়ে দুটির দিকে আঙুল তুলেছিলেন অনেকে। তাই অপরাধের শিকার হয়েই নারীর ভোগান্তি শেষ হয় না; বরং বারবার কারণে–অকারণে তাঁর চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়। 

নারী জন্ম থেকেই বয়ে বেড়ান অপরাধের বোঝা। যদি তিনি রূপবতী হন তবে তাঁকে শুনতে হয় তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারের শঙ্কার কথা। যদি তিনি রূপবতী না হন, তাহলেও তাঁকে শুনতে হয়, ‘এমন মেয়েকে বিয়ে করবে কে?’ যদি তিনি পড়ালেখায় ভালো হন, তবে তাঁকে বলা হয়, ‘এত পড়াশোনা করে কী হবে! এত বিদ্বান মেয়ের যোগ্য পাত্র পাব কোথায়?’ আবার পড়ালেখায় খারাপ হলেও শান্তি নেই। ভালো পাত্র জোগাড়ে কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা চাই-ই চাই। চাকরির ক্ষেত্রে কি শান্তি আছে! সেখানে নারী ভালো করলে তাঁর যোগ্যতা গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে চেহারা। আবার ক্যারিয়ারে খারাপ করলেও বলা হয়, ‘নারীর বুদ্ধি, যোগ্যতা কম ইত্যাদি!’ বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সুন্দর বোঝাপড়া হলে শুনতে হয়, ‘ছেলে বউপাগল। বউয়ের কথায় ওঠে-বসে।’ আবার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলেও শুনতে হয়, ‘তিনি স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে পারেন না!’ নারী পরকীয়ায় আসক্ত হলে সে দোষ নিশ্চিতভাবেই নারীর হয়ে থাকে। অন্যদিকে পুরুষটি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে সে দোষও কিন্তু নারীর। কারণ, নারীটি তাঁর পুরুষটিকে ঠিকমতো আগলে রাখতে পারেননি।

দেখেশুনে মনে হয়, নারী যেন শুধু তাঁর অপরাধেই ঘরে ঘরে নিগৃহীত হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন, যৌন উৎপীড়ন কিংবা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নারী নির্যাতনের ঘটনার জন্য প্রায়ই দায়ী করা হয় নারীর অবাধ চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা জীবনযাপনকে। নারীর প্রতি হওয়া অন্যায়ের কারণ হিসেবে এসবের দিকে আঙুল না তুলে বরং যে বা যারা অপরাধ ঘটাচ্ছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে মনোযোগী হতে হবে। 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক