তাঁরা এবার গেলেন ইউরোপীয় হাসপাতাল দর্শনে

স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেন বিদেশ সফরে ছিলেন, সেটা ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে জানাটা জরুরি ছিল। কিন্তু আমরা তা জানতে পারিনি। বরং প্রশ্ন করায় তিনি রেগে গেছেন বলেই পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে। এখন আমরা জানলাম, অন্তত দুজন অতিরিক্ত সচিব, দুজন মেয়রসহ ১৫ সদস্যের একটি সরকারি দল ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্স সফরে আছে। তাঁরা ২৭ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এখন হাসপাতাল দর্শন করছেন। পুরো ১০ দিনের সফর। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম, তাতে প্রশ্ন তৈরি হলো। সদুত্তর কম। ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে তাঁদের সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, মোটেই তা নয়।

যে প্রকল্পের অধীনে তাঁরা গেছেন, সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত। ইউরোপের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরেজমিন দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই থাকতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই প্রয়োজনটা কী, সেটি প্রাথমিক অনুসন্ধানে বুঝতে পারিনি। উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়েছিলাম। বিভাগটির প্রধান ওই প্রতিনিধি দলে আছেন। কথা হলো উপপ্রধানের সঙ্গে। বিভাগটির কাজই হলো সরকারকে স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক সহায়তা দেওয়া। বললাম, এই প্রকল্পে এ পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে, সেই বিষয়ে আমাদের একটু ধারণা দিন। তিনি বললেন, ‘আমরা কিছুই করিনি।’ তাহলে আপনাদের বস কীভাবে যুক্ত হলেন? বললেন, তিনি যখন এই বিভাগে ছিলেন না, তখন তাঁকে কমিটিতে রাখা হয়েছিল। গত বছর ১৮ জুলাই তিনি এই বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। উপপ্রধান অবশ্য আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি মেধাবী। তিনি নিশ্চয় অবদান রাখতে পারবেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটা চুক্তি হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতাধীন প্রকল্পটির নাম ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য পুষ্টি জনসংখ্যাবিষয়ক সেবা প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’। এ জন্য গঠিত রয়েছে ১৫ সদস্যের একটি টিম। যাঁরা বিদেশ সফরে আছেন, তাঁরা ফিরে এসে কী করবেন জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা সফরের পরিপত্র থেকে উদ্দেশ্য পাঠ করে শোনান। তাতে লেখা: ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পিপিপির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি দেখার জন্য এই সফর।’ কিন্তু ফিরে এসে তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কী করে কাজে লাগাবেন, সেটা একটা প্রশ্ন।

কর্মস্থল কারণে–অকারণে বদলের দেশ বাংলাদেশ। অনেক সময় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও এই বদলির কারণে তা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।

ওই তিন দেশেই আমাদের শক্তিশালী কূটনৈতিক মিশন আছে। ঢাকাতেও ওই তিন দেশের মিশন আছে। এটা আমরা জানতে চাই যে ওই সফরের আগে ১৫ সদস্যের টিম কতটা হোমওয়ার্ক করেছে। তাঁরা ওই তিন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যা তাঁরা ‘সরেজমিন’ দেখতে গেছেন, সে বিষয়ে তাঁদের তাত্ত্বিক জ্ঞান আগেভাগেই অর্জন করতে পারার কথা। ডিজিটাল মাধ্যমে তো এখন চাইলে ভার্চ্যুয়াল সফর করা সম্ভব। চোখে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের মতো বিষয় সামান্যই বাকি থাকার কথা।

সচিবালয়ে একজন কর্মকর্তাকে বললাম, দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়েই যখন কথা, ‘তাহলে ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ কেন? উত্তর পেলাম, ওই সব দেশেও তো দরিদ্র ব্যক্তি আছে। সেখানে কী করে স্বাস্থ্যসেবায় পাবলিক ও প্রাইভেট খাতের মেলবন্ধন ঘটেছে, সেই মডেলের কার্যকারিতা তাঁরা দেখবেন।’ কিন্তু খটকা হলো ১৫ জনের টিমে প্রাইভেট বা বেসরকারি খাতের লোক কোথায়? সবাই তো সরকারি। দুই মেয়রও সরকারি খাতের মানুষ। তাহলে আমরা খালি চোখে দেখি ‘অংশীদারত্বের’ শর্ত পূরণ হয়নি।

আরও বড় খটকা হলো, প্রকল্পের সময়সীমা। আমাদের জানানো হয়েছে, যে প্রকল্পে তাঁরা সফরে গেছেন, তার মেয়াদ ২০১৫ থেকে ২০২০। তাহলেই সাধারণ প্রশ্ন, এ রকম সফর তো তাহলে প্রকল্পের শুরুতে হওয়ার কথা। প্রকল্প শেষ হতে যখন দেড় বছরের কম সময় বাকি, তখন কেন এই অভিজ্ঞতা অর্জন। আবার পিপিপির এই প্রকল্প সম্পর্কে একটি ওয়েবসাইটে (ইপোস হেলথ ম্যানেজমেন্ট) দেখলাম, প্রায় ২০ লাখ ইউরো ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুনে শুরু হয়ে আগামী নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।

বিদেশ সফররত বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। আছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অতিরিক্ত সচিব। দলটিতে অন্য আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অর্থ বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের (পিপিপি ফোকাল পয়েন্ট) একজন যুগ্ম সচিব। আছেন মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একজন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিপিপি দেখেন যাঁরা তাঁদের থেকে একজন। আরও আছেন মাদারীপুর ও চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র। চাঁদপুরের পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে যে মেয়র (বিদেশ সফরের প্রাক্কালে) নগরবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। মাদারীপুরের প্যানেল মেয়র বললেন, পিপিপির আওতায় কোনো প্রকল্প মাদারীপুরে নেই। চাঁদপুরেও তা–ই। দুই মেয়রই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ওই টিমে চট্টগ্রাম ও ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও আছেন। আমি যখন মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে জানতে চাই যে আপনি কোনো কর্মকর্তাকে ইউরোপীয় হাসপাতাল দর্শনে পাঠিয়েছেন কি না, মুঠোফোনে তিনি তাৎক্ষণিক স্মরণ করতে পারেননি।

১৫ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলে ইইউর দুজন প্রতিনিধি আছেন। তাঁরাও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারেন।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ওই টিমের ইউরোপ ভ্রমণে অনেকে স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়েছেন। তা নিন। তবে কেউ আমাদের বলুন, ওই টিমের সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দেশে এসে কাজে লাগাতে পারবেন এবং পৌরসভাগুলোর স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে গরিব মানুষেরা আগের থেকে বেশি বেশি স্বাস্থ্য সেবা পাবেন।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক