একজন পঙ্কজ ভট্টাচার্য

পঙ্কজ ভট্টাচার্য
পঙ্কজ ভট্টাচার্য

ষাটের দশক আমাদের সময়ে ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। নেতা ছিলেন বদরুল হক, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক প্রমুখ। তাঁরা আর নেই। নেতা ছিলেন মতিয়া চৌধুরীও। এখনো আমার নেতা আছেন রেজা আলী, সারওয়ার আলী ও পঙ্কজ ভট্টাচার্য। অনেক ভালোবাসা নিয়ে এখানে যাঁদের নাম স্মরণ করলাম, তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুমুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এখনো যুক্ত আছেন।

 এই নেতাদের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ আর ঘনিষ্ঠতা শুরু সেই ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে। এখনো আমার এমন একটা দিন যায় না, যেদিন বহুমুখী প্রাত্যহিক ব্যস্ততার মধ্যে তাঁদের কথা বা বিষয়ে কোনো না কোনো কথা মনে না আসে। কারণ, তঁাদের সঙ্গেই আমি আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ সময় ’৬০–এর দশক অতিবাহিত করেছি। এখনো সেই দিনগুলো, রাতগুলোর কথা বড় বেশি উজ্জ্বল। আজকে এমন একজন পঙ্কজ ভট্টাচার্যের কথাই এখানে বলতে চাই।

পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে প্রথম দেখি ১৯৬৩ সালে রেলওয়ের মাহবুব আলী মিলনায়তনে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে। নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও প্রতিনিধিদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তিনি বিশেষ তৎপর ছিলেন। সঙ্গে দেখেছিলাম সাবেক সচিব ও আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ ওয়ালিউল ইসলামকেও। সম্মেলনের পর পঙ্কজদার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার শুরু, যা আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে। ভালোমন্দ বিপদ–আপদের সময় স্মরণ করি, পরামর্শ নিই পঙ্কজদার কাছ থেকে।

সেই পাঁচ দশকের অধিক সময়ের আগে যে পঙ্কজদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ এবং তাঁর বহুমুখী কর্মজীবনের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখি আজও তিনি তেমনি উদ্যোগী, তেমনি সক্রিয়। জাতি, ধর্ম বা রাজনৈতিক পরিচয়–নির্বিশেষে তিনি সবার সাহায্যে এগিয়ে যান। এখনো তিনি সেই আগের মতোই বাংলাদেশজুড়ে দৌড়াদৌড়ি করেন, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী-পুরুষ কিংবা নির্যাতিত যেকোনো মানুষের দাবি–দাওয়ার সপক্ষে থাকেন তিনি।

চট্টগ্রামের পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মা–বাবা ভারতে চলে যান সেই ১৯৬৪ সালে। মনে পড়ে যায়, যে ট্রেনে করে তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, সেই ট্রেনেই পঙ্কজদাকে চট্টগ্রাম জেল থেকে কুমিল্লা জেলে নিয়ে আসা হচ্ছিল। সেই পঙ্কজদা আছেন বাংলাদেশেই। তাঁর জীবন, ধর্ম, কর্ম—সবকিছু মিলেমিশে একাকার, কোনো কিছু থেকে তঁাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

পঙ্কজদার কথা ভাবলেই মনে পড়ে, সেই সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি-স্যান্ডেল পরা উজ্জ্বল এক টগবগে যুবক, ঢাকায় কোনো কর্মিসভা, সম্মেলন বা বড় বড় সভায় বক্তৃতা করছেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙনের আগে এবং পরে তিনি দেশব্যাপী সংগঠন আর আন্দোলনের কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

ষাটের দশকের কথা মনে হলে পঙ্কজদাকে নিয়ে আরও অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। তিনি বারবার জেলে গিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দেওয়া হয়েছিল। আর জেলে যাওয়া এবং বের হওয়ার মধ্যে তিনি আমাদের বংশালের বাসভবনে এসেছেন, থেকেছেন। আমার ছোট ছয় ভাইবোনের সঙ্গে গল্প করেছেন, আবৃত্তি করেছেন। উদার কণ্ঠে গান করেছেন। আমার সংগ্রহে এখনো এমন একটি ছবি আছে, যেখানে তিনি আমাদের বাড়ির ছাদে আমার পাঁচ বোন এবং এক ভাইয়ের সঙ্গে গল্পে, কৌতুকে মেতে উঠেছেন। এমনও হয়েছে নাজিমুদ্দিন রোডের জেলখানা থেকে বের হয়ে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে সরাসরি বংশালে আমাদের বাসায় এসে উঠেছেন। এসবই সম্ভব হয়েছে আমাদের মায়ের আশ্রয়ে–প্রশ্রয়ে। জেল থেকে তিনি যখন কোর্টে হাজিরা দিতে আসতেন, তখন আমি তাঁর জন্য আমার এক বোনের দেওয়া মিষ্টি পরানহারা (প্রাণহরা) নিয়ে হাজির হতাম। সে দিনগুলির কথা এখনো বড় বেশি মনে পড়ে।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ১৯৬৬ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ৭০ এবং ৮০–র দশকে রাজনীতির উত্থান-পতনের মধ্যে তিনি দলীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীলতার পথে দেশ এবং জাতিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। ন্যাপ ছেড়ে দিয়ে গণফোরাম গঠনের সময়ে ছিলেন। এখন তিনি ঐক্যন্যাপে রয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সামাজিক আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের সব সংগঠন ও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এখন পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ন্যাপ হলো না, গণফোরাম হলো না, তাঁর ঐক্যন্যাপও হচ্ছে না। আসলে নানাভাবে অনেক কারণে এ সংগঠনগুলোর কার্যকারিতাই হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমাদের নতুন কোনো পথের সন্ধান করতে হবে। নতুন কোনো নেতৃত্বের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সেই নতুন পথ সন্ধানে আমার নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য কি কিছু বলতে পারেন? 

তাঁর কথা মনে হলেই, সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা তরুণ বয়সে পঙ্কজ ভট্টাচার্য এবং মাথায় ঘন কালো চুল আর ভরাট কণ্ঠে তাঁর আবৃত্তি বা গানের সুর এখনো আমি দেখতে ও শুনতে পাই। পঙ্কজদাকে ভুলে থাকা বা ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। আর, এখনো পঙ্কজদাকে যিনি সাজিয়ে গুছিয়ে সুস্থ রেখেছেন আমার সে বোন রাখী দাশপুরকায়স্থ, তাঁকে শুভেচ্ছা জানাই। একই সঙ্গে মোহাম্মদ ফরহাদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রেজা আলী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সারওয়ার আলীর সঙ্গে আমরা যাঁরা হাজার হাজার কর্মী যুক্ত ছিলাম, তাঁদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই, অভিবাদন জানাই। 

মতিউর রহমান প্রথম আলোর সম্পাদক­

 আরও পড়ুন: