জম্মু-কাশ্মীরের এক নতুন অধ্যায়

জম্মুর রাস্তায় রাস্তায় এখন পাহারা বসানো হয়েছে। ছবি: এএফপি
জম্মুর রাস্তায় রাস্তায় এখন পাহারা বসানো হয়েছে। ছবি: এএফপি

একটি–দুটি নয়, এক ঢিলে একাধিক পাখি মেরে দিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। এবং তা করা হলো রাতারাতি, বিরোধীদের গহন অন্ধকারে রেখে। সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপই শুধু নয়, যেভাবে জম্মু–কাশ্মীর এত দিন ধরে পরিচিত হয়ে এসেছে, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে সেই অবস্থানেরও বদল ঘটানো হলো। লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করা হলো জম্মু–কাশ্মীর থেকে। এবার থেকে তাদের পরিচিতি হবে নিছকই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। লাদাখের বিধানসভা থাকবে না, জম্মু–কাশ্মীরের থাকবে। দুই অংশেরই ভার থাকবে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে। এই নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পালনের মধ্য দিয়ে বিজেপির হাত দিয়ে শুরু হলো জম্মু–কাশ্মীরের এক নতুন অধ্যায়, যা ভবিষ্যতে কী রকম বাঁক নেবে, সেই ধারণা এখনো কারও নেই। 

কোন পরিস্থিতিতে এত বড় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত মোদি সরকার নিল, তা দেখা প্রয়োজন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ছন্নছাড়া। পাক্কা দুই মাস কেটে গেলেও তারা এখনো তাদের নেতৃত্বের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারল না। সংসদীয় অধিবেশন শেষ হওয়ার পর ১০ আগস্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। হয়তো সেই বৈঠকে অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হবেন। এর মানে আরও কিছুদিনের অপেক্ষা। 

কিন্তু এত দিন কী দেখা গেল? সংসদের অধিবেশন চলছে অথচ রাহুল গান্ধী বেপাত্তা! বিদেশ ঘুরে দিল্লি ফিরেছেন তিনি কিছুদিন হলো, অথচ লোকসভায় আসছেন না! পার্টি অফিসে যাচ্ছেন না! কী যে করছেন, কেউ জানে না! জানলেও বলছে না। গোয়ায় ১৫ জন বিধায়কের মধ্যে ১০ জন বিজেপিতে যোগ দিলেন, তাঁর মধ্যে হেলদোল দেখা গেল না। কর্ণাটকে সরকার পড়ে গেল। তিনি প্রতিক্রিয়াহীন। মহারাষ্ট্রে দলে ভাঙন ধরেছে। রোজ একজন–দুজন বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। কে হাল ধরবে বোঝা দায়। শারদ পাওয়ারের সঙ্গে জোট কেমন হবে, কী করে বিজেপির মোকাবিলা করা যাবে, কারও কাছে কোনো হদিস নেই। ছয় মাসের মধ্যে চার রাজ্য বিধানসভার ভোট। বিজেপি আসরে জাঁকিয়ে বসেছে। তুলনায় কংগ্রেসিরা যেন ফ্যা ফ্যা করে ঘোরা দিশাহীন অনাথ বালক! 

এই পরিসরে শাসক দল ফাঁকা মাঠে একটার পর একটা গোল দিয়ে চলেছে। জম্মু–কাশ্মীর নিয়ে যা করল, তা তো রীতিমতো ধামাকা! কারও কোনো পরোয়া নেই। কাউকে তোয়াক্কা করারও নেই। গণতন্ত্রে যাকে বলে ‘ব্রুট মেজরিটি’, সেই শক্তিতে ভর দিয়ে বিজেপি সংসদের ভেতর ও বাইরে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের যাবতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ‘অ্যাজেন্ডা’ সাকার করতে। করবে নাই–বা কেন? তারা বুঝে গেছে বিরোধীরা ছত্রখান। কারও ফুসফুসে বিন্দুমাত্র দম নেই। সংসদ অচল করে দেওয়ার মুরোদ নেই। শাসকের ইচ্ছাই প্রথম ও শেষ কথা। 

নমুনাগুলো জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিস্ফোরক প্রস্তাবের কথা জানালেন। বললেন, মোদি নাকি তাঁকে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। সংসদে তা নিয়ে ব্যাপক হইচই হলো। একটা সময় ছিল, প্রধানমন্ত্রীরা নিয়ম করে বিদেশ সফরের পর সংসদে এসে বিবৃতি দিতেন। প্রথা ভাঙা মোদি সেই রীতি তুলে দিয়েছেন। এত বড় একটা কথা ট্রাম্প বললেন, তারপরও তিনি সংসদের কোনো কক্ষেই যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না! পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে জানালেন, তেমন কোনো প্রস্তাব তিনি দেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অসত্য ভাষণ যে কার, সেই বিতর্ক অতএব অমীমাংসিতই রইল। মুখ খোলানো তো দূরের কথা, মোদি সংসদে হাজিরাই দিলেন না! 

এই কদিন আগে ৪৯ জন বিশিষ্ট মানুষ উদ্বেগভরা চিঠি লিখলেন প্রধানমন্ত্রীকে, যাতে ধর্মের নামে গণপিটুনি ও হত্যা বন্ধ হয়। সেটা যেন ছিল আগুনে ঘৃতাহুতি! দুই দিনের মধ্যেই ৬২ জন অন্য বিশিষ্ট মানুষ পাল্টা খোলা চিঠি লিখলেন। তাতে প্রবল বাপবাপান্ত করা হলো ওই ৪৯ জনের মানসিকতার, ‘একচোখোমির’ এবং ‘ভণ্ড ধর্মনিরপেক্ষতার’। গোহত্যার নামে গণপিটুনি ও গণহত্যার ধারকাছ দিয়ে না হেঁটে তাঁরা টেনে আনলেন অন্য বহু ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা দেখা সত্ত্বেও কেন তাঁরা একই রকম প্রতিবাদী হননি, সেই প্রসঙ্গ। বলা হলো, এঁরা বিদেশের কাছে দেশের উঁচু মাথা হেঁট করছেন। মোদির স্বপ্নের ভারত গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। দেশদ্রোহিতাকে সমর্থন করছেন। 

 ‘সরকারি’ বুদ্ধিজীবীদের এই মানসিকতার সঙ্গেই দেখতে হবে সংসদে দু–দুটো আইন সংশোধনের ঘটনাকে। বেআইনি কাজকর্ম বন্ধ আইন, সংক্ষেপে যা ‘ইউএপিএ’ বলে পরিচিত, তা সংশোধিত হয়েছে। এর ফলে সরকার এবার থেকে ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদীর তকমা দিয়ে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখতে পারবে। বিলটির বিতর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোনো ভণিতা না করেই জানিয়েছেন, যেসব ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আদর্শগতভাবে সমর্থন করেন (সরকারের চোখে যাঁরা ‘আরবান নকশাল’), তাঁদের প্রতি তাঁর সরকারের বিন্দুমাত্র মায়া, মমতা, সহানুভূতি নেই। এই সব মানুষ, যাঁরা মানবাধিকারের লড়াই করেন, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সরব হন, গণপিটুনির বিরোধিতা করেন, কে জানে কোনো একদিন তাঁদের দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদী দেগে জেলবন্দী করা হবে না? 

দ্বিতীয় সংশোধিত আইনটি তথ্য জানার অধিকারসংক্রান্ত বা ‘আরটিআই’। বহু লড়াই শেষে ভারতের মানুষ এই অধিকার আদায় করেছিল। তথ্য কমিশনাররা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারতেন, যেহেতু কাজের মেয়াদ ছিল নির্দিষ্ট। আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে তথ্য কমিশনারদের নিয়োগ, বেতন, কাজের মেয়াদ কেন্দ্রীয় সরকার তার হাতে নিয়ে নিল। সরকারের মর্জি–মাফিক চলা ছাড়া অতঃপর তথ্য কমিশনারদের উপায় থাকবে না। তা ছাড়া, এই আইনবলে রাজ্যের অধিকারও চলে যাবে কেন্দ্রের হাতে। লোকসভায় যেকোনো বিল পাস করা এখন বিজেপি সরকারের কাছে জলভাত। বাধা ছিল শুধু রাজ্যসভা। সেই বাধাও ‘ছলে–বলে–কৌশলে’ বিজেপি দূর করে দিয়েছে। গরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও রাজ্যসভাতেও সরকারের ইচ্ছাই যে প্রথম ও শেষ কথা, নরেন্দ্র মোদির সরকার বলে বলে তার প্রমাণ দিচ্ছে। 

সংসদের ভেতর ও বাইরে মোদি সরকারের আচরণে অদ্ভুত রকমের এক চঞ্চলতা ও দৃঢ়তা দৃশ্যমান। ভাবটা এমন, হাতে বেশি সময় নেই। বকেয়া কাজ প্রচুর। অতি দ্রুত অনেক কিছু সরকারকে করে ফেলতে হবে। সে জন্য প্রতিদিন নিয়ম করে একটা–দুটো বিল তড়িঘড়ি পাস করানো হচ্ছে। রাজ্যসভার এক বিরোধী সাংসদ দিনকয়েক আগে চরম কটাক্ষে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমরা বিল পাস করছি নাকি পিৎজা ডেলিভারি দিচ্ছি?’ এমন প্রশ্ন তিনি করতেই পারেন। কারণ, এই অধিবেশনে ইতিমধ্যেই ২৩টি বিল পাস হয়ে গেছে। একতরফাভাবে বাড়ানো হয়েছে অধিবেশনের মেয়াদ। শোনা যাচ্ছে, চলতি অধিবেশনে ৩৫টা বিল পাস করিয়ে গিনেস বুকে নাম তুলবে মোদি সরকার। বিরোধীদের দাবি মেনে বিশদ আলোচনার জন্য একটা বিলও স্ট্যান্ডিং কমিটি অথবা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়নি। কোনো বিল আইনের চোখে টিকবে কি না, সেই তোয়াক্কাও সরকারের নেই! এত দ্রুতগামী সরকার এই দেশে এযাবৎ দৃশ্যমান ছিল না! 

এই বিস্ময়ের নবতম সংস্করণ জম্মু–কাশ্মীর সিদ্ধান্ত। কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা হলো না। একবারের জন্যও সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হলো না। সবাইকে অন্ধকারে রেখে নেওয়া হলো এত বড় এক সিদ্ধান্ত, যার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। 

বিরোধীরা নির্জীব ও নির্বিষ। সরকার বেপরোয়া। তাদের আচরণ শুধু বুঝিয়ে দিচ্ছে, গতিই জীবন। গতিহীন জীবন অর্থহীন। হাতে সময় কম। অর্জন বাকি বহু কিছু। 

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি