এডিস মশা দূর করুন তাহলেই ডেঙ্গু শেষ

আক্ষরিক অর্থে নয়, তবে মশারি ব্যবহার করলে ডেঙ্গুর আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। শুধু মশারি নয়, পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি যেন বাসার আশপাশে জমে না থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাহলে এডিস মশা বাড়তে পারবে না। কিন্তু এখন আরেক বিপদ এসেছে। আগে ছিল এক রকম, এখন চার রকম ডেঙ্গু ভাইরাস। আরও একটি নাকি আসছে। ফলে একই ব্যক্তি চার–পাঁচবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। আগে তো একবার ডেঙ্গু হলে আর হতো না।

তাহলে জনসচেতনতা ও সবার সচেতন, সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আমাদের সনাতন চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন আগে ভাবতাম ডেঙ্গুর মৌসুমে কিছু কামান দাগালেই চলবে। কিন্তু এখন আর সেই কৌশলে কাজ হচ্ছে না। সারা বছর ডেঙ্গু মশার বিরুদ্ধে সক্রিয় অভিযান চালাতে হবে। এবং সেটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। প্রতিটি এলাকায় তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী দল থাকবে। ওরা পালা করে নিজ নিজ বাসা বা অ্যাপার্টমেন্টে পরীক্ষা করে দেখবে কোথাও পানি জমে আছে কি না। বৃষ্টির পর দেখতে হবে কোনো পাত্র বা গাছের কোটরে পরিষ্কার পানি জমে আছে কি না। তাহলে সেই পানি ফেলে দিতে হবে। কারণ, এডিস মশা মারতে হলে পরিষ্কার পানি কোথাও জমতে দেওয়া যাবে না। সারা বছর সচেতন থাকলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারবে না। 

এই কথাগুলো আমরা সবাই জানি। তা-ও লিখছি। কেন? শুধু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। ভুলে গেলে বা সামান্য কাজটুকু না করলে যে কি সাংঘাতিক ঝুঁকিতে পড়তে হয়, এখন আমরা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ল্যাবএইড হাসপাতাল ও প্রথম আলোর উদ্যোগে মাত্র কয়েক দিন আগে ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে জরুরি করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বারবার অনুরোধ করেছেন, আমরা যেন এই পুরোনো কথাগুলো বারবার মানুষকে মনে করিয়ে দিই। এর একটি বিরাট মূল্য আছে। কারণ, কাল যখন ডেঙ্গু চলে যাবে, আমরা ভুলে যাব। আবার আগামী বছর যখন ডেঙ্গু জেঁকে বসবে, তখন শুধু ডেঙ্গুতেই নয়, আতঙ্কেও মরব। 

বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বারবার একটা কথা বলছিলেন। বলছিলেন, আতঙ্ক নয়। হয়তো জটিলতার কারণে কোনো কোনো ডেঙ্গু রোগীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সাধারণ পরামর্শ হলো, জ্বর হলে প্রথমে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি প্রটোকল অনুযায়ী পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বলবেন, হাতপাতালে ভর্তি হতে হবে নাকি বাসাতে থেকেই সুচিকিৎসা সম্ভব। গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে বেশ কিছু শিক্ষণীয় কথা আমরা জানতে পেরেছি। যেমন আগে ভাবতাম, রক্তের প্লাটিলেট ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেলে বিপদের আশঙ্কা খুব বেশি। কিন্তু সেদিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বললেন, প্লাটিলেট অবশ্যই বেশি থাকতে হবে, তবে যদি কমেও যায়, তাহলেও চলে। অবশ্য চিকিৎসায় সতর্ক থাকতে হবে। 

একসময় বলা হতো ডেঙ্গু হলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। কথাটা ঠিক। কিন্তু একই সঙ্গে তার যদি কাশি বা অন্য কোনো সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়ে যায় এবং অ্যান্টিবায়োটিক অপরিহার্য হয়ে ওঠে, ডাক্তার যদি মনে করেন তার অ্যান্টিবায়োটিক দরকার, তাহলে ক্ষতি নেই। আসল কথা হলো, কোনো ভাইরাস দমনে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে লাগে না। সে জন্যই ডেঙ্গু ভাইরাসে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দেন না। 

আরেকটি ভুল ভাঙল, যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বললেন, ডেঙ্গু হলে প্রচুর পানি খাওয়ার যে পরামর্শ দেওয়া হয়, সেটা সাধারণভাবে ঠিকই আছে। কিন্তু নির্বিচারে বেশি পানি খেলে ফুসফুসে পানি জমে আরেক বিপদে পড়তে হতে পারে। সাধারণভাবে বলা হয়, পিপাসা লাগলে পানি খাও। ডেঙ্গু বা অতিরিক্ত জ্বরে হয়তো একটু বেশি পানি লাগে। কিন্তু সেটা বেহিসাবি হলে চলবে না। 

ডেঙ্গু রোগের নতুন নতুন ভাইরাস আসছে। তাই একবার ডেঙ্গু হলে তিনি শুধু সেই নির্দিষ্ট স্ট্রেইনের ভাইরাস-প্রতিরোধী হন। কিন্তু তিনি যদি ডেঙ্গুর পরিবর্তিত নতুন স্ট্রেইনের ভাইরাসে আবার আক্রান্ত হন, তাহলে ডেঙ্গুর আক্রমণ তার জন্য ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তাই এ ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। 

তবে আমরা তো চাই ডেঙ্গু যেন আমাদের ধরতে না পারে। লেখার শিরোনামেই বলেছি, এডিস মশা দূর করুন, তাহলেই ডেঙ্গু শেষ। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। কিছু উপায়ও বেরিয়েছে। পুরুষ এডিস মশার এমন জেনেটিক পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে যে সেই মশার শুক্রাণুতে নিষিক্ত হয়ে স্ত্রী জাতীয় মশার ডিম থেকে জন্ম নেওয়া এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করতে পারবে না। এ রকম লাখ লাখ জিএম এডিস মশা লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে পরীক্ষামূলক ছাড়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় আছেন। দেখা যাক, এভাবে ডেঙ্গুর বংশ নিপাত করা যায় কি না। 

কিন্তু আমরা বসে না থেকে আসুন পাড়ায় পাড়ায় দলে দলে নেমে পড়ি। বাসায় বাসায় নিজেরাই সপ্তাহে অন্তত দুই দিন পরীক্ষা করে দেখি, কোথাও এডিস মশার জন্মস্থল, পরিষ্কার পানি জমে আছে কি না। থাকলে তা দূর করি। 

তাহলেই এডিস মশা শেষ। ডেঙ্গুও নির্মূল! 

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক