কাশ্মীর সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় ও মধ্যস্থতা

কারফিউ চলাকালে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যের প্রহরা। জম্মু, ভারত, ৭ আগস্ট। ছবি: এএফপি
কারফিউ চলাকালে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যের প্রহরা। জম্মু, ভারত, ৭ আগস্ট। ছবি: এএফপি

একসময় নৈসর্গিক শোভার জন্য যে স্থানটি বিখ্যাত ছিল,সেই কাশ্মীর উপত্যকা এখন ভারত ও পাকিস্তানের জন্য প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই সপ্তাহে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশটির সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে, যা একসময় মুসলিম অধ্যুষিত ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। দিয়েছিল স্বশাসনের অধিকার। 

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি বিজেপি সরকার। জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার জন্য লোকসভায় একটি বিলও উত্থাপন করেছে। ভারতে রাজ্য সরকারগুলো স্থানীয় ইস্যুতে স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে, তবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে নয়াদিল্লি সব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে। যেহেতু লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাই বিলটি সহজেই পাস হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিলটি ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় পাস হয়েছে। এখন লোকসভায় পাস হলেই বিশেষ রাজ্যের অধিকার হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। 

এ ছাড়া সংবিধানের ৩৫–এ অনুচ্ছেদও বাতিল করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শুধু স্থানীয় কাশ্মীরিদের তাদের নিজ রাজ্যে চাকরি পাওয়ার ও জমি কেনার অধিকার আছে। অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় এখন ভারতের যে কেউ কাশ্মীরে জমি কিনতে ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন। কাশ্মীরিরা সরকারের এই পদক্ষেপকে তাদের জনমিতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখছে। তাদের আশঙ্কা, যদি কাশ্মীরে অ-কাশ্মীরিদের আসতে এবং ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে শিগগিরই এটি মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলে পরিণত হবে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার স্লোগান প্রচার করে বিজেপি চলতি বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পুনর্নির্বাচিত বিজেপি সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করবে। কাজেই ভারতের রাজনীতিতে সর্বশেষ ঘটা ঘটনাটি অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। তবে বিজেপি যেভাবে এটি করেছে, তা নৈতিক ও আইনগত দিক দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ।

সংবিধান সংশোধনের জন্য বিজেপিকে ৩৭০ ধারা বাতিল–সংক্রান্ত বিলটির ব্যাপারে কাশ্মীরের বিধানসভার অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে গত বছর বিজেপি জম্মু-কাশ্মীরের জোট সরকার থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর সেখানে রাজ্যপালের শাসন জারি হয়। বিধানসভার কোনো কার্যক্রম চলছে না, তা জেনে বিজেপি রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে ৩৭০ ধারা বাতিল করার ব্যাপারে রাজ্যপালের সমর্থন আদায়ের জন্য তার ক্ষমতা ব্যবহার করে। সরকারের এই পদক্ষেপ যদি সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়, তবে এটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। 

তবে বিজেপির বুদ্ধিমান নেতারা জানেন যে সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো কার্যক্রম প্রচুর সময় নেয়, যা সরকারকে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দেবে এবং পরবর্তী সময়ে আদালত যেগুলোর প্রতিকার করতে অক্ষম হবেন। উদাহরণস্বরূপ, অ-কাশ্মীরি ভারতীয় যাঁরা কাশ্মীরে সম্পত্তি কিনেছেন বা বাড়িঘর তুলে বসবাস করছেন, তাঁদের আদালত অপসারণ করতে পারবেন না, কারণ তাঁরাও পাল্টা এ–জাতীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন।

নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি তাদের পরিকল্পনাটি চতুরতার সঙ্গে সম্পাদন করতে পারে, তবে একই সঙ্গে তারা জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতাকেও অবমূল্যায়ন করেছে। বর্তমানে কাশ্মীর উপত্যকায় প্রায় কারফিউর মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে, ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী ২৪ ঘণ্টা টহল দিচ্ছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন পরিষেবা স্থগিত করা হয়েছে। বিজেপি হয়তো এভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম, তবে তারা এটা খুব বেশি দিন করতে পারবে না। 

অচিরেই কাশ্মীরের জনগণের আন্দোলনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যাবে, কাশ্মীরের জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে, যা সরকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার বিষয়টিকে প্রায় অসম্ভব করে তুলবে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময় কাশ্মীরের শাসকেরা স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন কাশ্মীর দখল নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন স্থানীয় শাসকেরা এই শর্তে ভারতের সঙ্গে নিজেকে একত্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কাশ্মীর হবে স্বশাসিত একটি রাজ্য। মোদির সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো তাঁর সমর্থকদের হয়তো খুশি করেছে, তবে এটা ঠিক যে তিনি এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দীর্ঘকালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন।

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাশ্মীর সব সময়ই একটি গোলযোগপূর্ণ এবং এটি বিশ্বের অন্যতম সামরিককৃত অঞ্চল। পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ই গোটা কাশ্মীর উপত্যকার মালিকানার দাবি করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরেই কাশ্মীরের যুবকেরা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর নির্মম আচরণের শিকার হয়ে আসছেন এবং একই সঙ্গে ভারত দাবি করে আসছে যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য পাকিস্তান তাঁদের উৎসাহিত করছে। 

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আধা সামরিক বাহিনীর নির্মম আচরণের ফলে কাশ্মীরের যুবকদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা অসহায়ের মতো, যেমনটা অসহায়ত্ব সংস্থাটি প্রদর্শন করেছে সিরিয়া, লেবানন ও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে। জাতিসংঘ কেবল পাকিস্তান ও ভারত উভয়কেই সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি জারি করে। সংস্থাটির যদি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো সত্যিকারের ক্ষমতা থাকত এবং দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারত, তবে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন বাঁচানো যেত এবং লাখ লাখ নাগরিক ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদের উগ্রতা থেকে রক্ষা পেত।

সম্ভবত এখনই বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাশ্মীরের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। সময় হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে চলা লড়াই থেকে কাশ্মীরকে বাঁচানোর। জাতিসংঘের উচিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করাকে অমানবিক আচরণ হিসেবে নিন্দা করা এবং ধর্ম ও জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের নামে কাশ্মীরিদের ওপর আরও অত্যাচার করা থেকে রক্ষা করা।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ইমাদ জাফর পাকিস্তানি সাংবাদিক ও কলাম লেখক