উচ্চশিক্ষা ধ্বংসের আওয়াজ পাই

বাংলাদেশে এখন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। খুব সম্ভবত ৪৫টি হবে। হিসাব রাখা কঠিন, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গজাচ্ছেই। সংগত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান সমান নয়। এই বৈষম্য থাকা খুব স্বাভাবিক এবং না থাকাটাই হতো অস্বাভাবিক। অথচ সরকার, সরকারের আমলা এবং সরকার-সমর্থিত শিক্ষকনেতারা এই স্বাভাবিক বিষয়কে অস্বাভাবিক ভাবছেন। শুধু ভাবছেনই না, এখন এই বৈষম্য দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালার প্রস্তাব করেছেন। সবার জন্য একই মান বা অভিন্ন মান কথাটার মানে কী? সেটির মানে কি কারও বর্তমান মান কমিয়ে আর কারও বর্তমান মান সামান্য একটু বাড়িয়ে গড় মানে নিয়ে আসা? এটি করতে হলে ভালোগুলোকে নিচে নামতে হবে, যা কোনো কাজের কথা নয়।

জানতে পারলাম যে সেই খসড়া অভিন্ন নীতিমালায় প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব তোলা হবে। সেখানে প্রভাষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে মৌখিক পরীক্ষার আগে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ ধরনের লিখিত পরীক্ষার কথা জানা নেই। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই লিখিত পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে এবং সেখানে সরকারের গুণগান ও ট্রান্সলেশন ধরনের প্রশ্ন এসেছে। শোনা যায়, এতে দেশের বাইরে অত্যন্ত ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় রত প্রার্থী লিখিত পরীক্ষাতেই বাদ পড়েছেন। বলা যায়, বাদ দেওয়ার জন্যই নতুন এই অভিনব পদ্ধতি।

এই সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী, তার উদাহরণ এখনই দেওয়া সম্ভব। আগে চারটি প্রথম শ্রেণি পাওয়া একজন প্রার্থী বাদ পড়লে অন্তত পত্রপত্রিকায় সমালোচনা হতো। এখন ফাঁস করা প্রশ্নে একজন তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ দিয়ে দিলেও কিছু বলা যাবে না, কারণ নিয়োগদাতারা লিখিত পরীক্ষায় ফেলের উদাহরণ তুলে আনবেন। হয়তো বলা হবে, চারটি প্রথম শ্রেণি পাওয়া প্রার্থী তো লিখিত পরীক্ষায় পারেননি, মুখস্থ করেছেন যিনি, তিনি প্রথম হয়ে গিয়েছে। চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স পরীক্ষায় ৪০ থেকে ৪৫টি কোর্সের লিখিত পরীক্ষায় যিনি প্রথম হলেন, তাঁকে নিয়োগকর্তাদের সাজানো এক ঘণ্টার ১০০ নম্বরের একটি লিখিত বা এমসিকিউ পরীক্ষার মাধ্যমে বাতিল করে দেওয়ার কী চমৎকার আয়োজন!

বিশ্বের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদের সর্বনিম্ন স্তরের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা হয়ে থাকে পিএইচডি ও ন্যূনতম একটি পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা। তাঁরা কিন্তু স্কুল বা কলেজ পর্যায়ের পরীক্ষার ফল আদৌ জানতে চান না। এগুলো দেখিয়েই তো প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এবং পিএইচডি করেছেন। তাই এ পর্যায়ের জন্য কেবল গবেষণাই দেখা হয়। কথায় আছে, বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়। ঠিক তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন হবেন, সেটি তাঁর গবেষণায় পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা কেবল শ্রেণিকক্ষেই পড়ানো নয়; বরং ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা শেখানো এবং উৎসাহিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন গবেষক তৈরি করাও সহজ কাজ নয়। পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে নিয়োগ দেওয়া হলে একজন তৈরিকৃত গবেষককে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।

অন্যদিকে, ইউজিসি অভিন্ন নীতিমালায় প্রভাষক পদের জন্য এসএসসিতে জিপিএ-৫ ও এইচএসসিতে জিপিএ-৪.৫-সহ মোট জিপিএ-৯.৫ থাকার কথা বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য এসএসসি-এইচএসসির ফল কেন দেখা হবে? আবার এর মধ্যেও অনেক অসংগতি আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম জিপিএ-৮ চাওয়া হয়। এখন যে শিক্ষার্থী জিপিএ-৮ বা ৯.৫-এর কম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, তাঁকে প্রথম দিনেই কি নেতিবাচক বার্তা দেওয়া হলো না যে তিনি অনার্স আর মাস্টার্সে প্রথম হয়ে পরবর্তী সময়ে এমআইটি বা হার্ভার্ডে পিএইচডি করে ওখানকার শিক্ষক হতে পারলেও বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোনো দিনই হতে পারবেন না। আবার অনার্সে ন্যূনতম জিপিএ-৫ পেতে হবে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী অনার্সে জিপিএ-৩.৫-এর চেয়ে কম পেয়েও আমেরিকার ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ হয়তো খুব ভালো পিএইচডি ও ভালো পোস্ট-ডক করে হয়তো এমআইটি হার্ভার্ডের শিক্ষক হতে পারবেন, কিন্তু বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না।

প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালায় কোথাও পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতার কথা বলা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য এই অভিজ্ঞতা খুবই জরুরি। পৃথিবীর এমন একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে পারবেন না, যেখানে প্রতিটি বিভাগে বেশ কিছু পোস্ট-ডক গবেষক নেই। অথচ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগেই আমি যত দূর জানি, কোনো পোস্ট-ডক নেই। শুধু তা-ই নয়, পিএইচডিকে পর্যন্ত সাংঘাতিকভাবে অবহেলিত রাখা হয়েছে। যেখানে পৃথিবীর কোথাও প্রাথমিক স্তরেই পিএইচডিবিহীন শিক্ষক হতে পারে না, সেখানে আমরা পিএইচডিবিহীন অধ্যাপক হওয়ার সুবন্দোবস্ত রেখেছি। এর চেয়ে আত্মঘাতী নিয়ম কি আর হতে পারে? প্রস্তাবিত নিয়মটি পড়লেই বোঝা যায়, পিএইচডি আর পোস্ট-ডককে কীভাবে অবহেলা করা হয়েছে। এর কারণ কী? কারণ, যিনি এই অভিন্ন নীতিমালা তৈরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর নিজেরই পিএইচডি ছিল না। এ রকম একজনকে শুধু দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় ইউজিসির চেয়ারম্যান বানানোই ছিল প্রথম ভুল।

পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা প্রচণ্ডভাবে শুরুর অবস্থানির্ভর। প্রভাষক হিসেবে কে আগে যোগদান করলেন, সেটি একটি বিরাট ঘটনা। যোগদানের দিক দিয়ে সিনিয়রকে ডিঙানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। পরে যোগদান করে যত ভালো গবেষণা করে যত বড় গবেষকই হোক, আগে যোগদান করা কাউকে ডিঙানোর ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। আগে যোগদান করা শিক্ষক যদি প্রতিটি পদোন্নতির পর কেবল ন্যূনতম শর্ত পূরণ করে পরবর্তী পদোন্নতির জন্য আবার ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করেন, তাহলে তাঁকে আর কেউ ডিঙাতে পারবেন না। এখানে আগে জন্মানো আর আগে যোগদানকে স্বর্গীয় বিধান ভাবা হয়। ব্যতিক্রমী মানুষদের জন্য নিয়মে ব্যতিক্রম রাখাটাও জরুরি, নইলে ব্যতিক্রমী মানুষ জন্মাবে না। এ ছাড়া সব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়েই যিনি ভালো করবেন, তিনি দ্রুত পদোন্নতি পাবেন, আর যিনি পারবেন না, তিনি পিছিয়ে থাকবেন—এটিই নিয়ম। এখানে বয়স কিংবা চাকরির মেয়াদের চেয়ে যোগ্যতার মূল্য হাজার গুণ বেশি। যাঁরা নিয়োগ বোর্ডে থাকবেন, তাঁদের এ বিষয়গুলোকে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হলে বিশ্বমানের নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা দরকার। একই সঙ্গে বিশ্বমানের সুযোগ, সুবিধা ও সম্মানও দরকার, যেন বর্তমানে যে মেধা পাচার হচ্ছে, সেটাকে উল্টে আমরা মেধা অর্জনের পথে হাঁটতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের সত্যি সত্যি উন্নতি চাইলে এসব যুক্তি উপেক্ষার সুযোগ নেই। সঙ্গে একটি সহজ পথ বলছি। গত বছর ভারতের ইউজিসি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ৫০০-র মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। আমরা এটাকে আরেকটু বাড়িয়ে বলতে পারি, ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ৮০০-র মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হবে না। ইদানীং প্রায়ই আমার কাছে ছাত্রছাত্রীরা আসেন বা ই–মেইল কিংবা মেসেঞ্জারে লিখে জানান যে তিনি আমেরিকা, ইতালি, জাপান কোরিয়ার ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেও আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাচ্ছেন না। তাঁদের চাকরি দেওয়া হয় না, কারণ তাঁদের রাজনৈতিক মদদ নেই। অথচ আমাদের ভালো পিএইচডি করা শিক্ষকের বড় অভাব। ফলে, আমার ছাত্ররা যারা ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে, তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে ওখানে থেকে যেতে।

অভিন্ন নিয়ম ও নীতিমালার নামে যা হচ্ছে, তা পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না। এসব করাই হচ্ছে শিক্ষার মানকে পঙ্গু করার জন্য। এখনই এই হীন উদ্যোগ বন্ধ করুন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো সমিতি, ফেডারেশন বা কর্মকর্তা দিয়ে যুগোপযোগী শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা তৈরি সম্ভব নয়। যেসব শিক্ষক একবার সমিতির নেতা হন, তাঁদের চোখ শিক্ষকতা থেকে সরে গিয়ে পদ-পদবির দিকে চলে যায়। তাই যুগোপযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা করতে হলে প্রথমে শিক্ষা ও গবেষণায় সক্রিয় এমন শিক্ষকদের নিয়ে একটি সাবকমিটি গঠন করে সুপারিশমালা চাইতে পারেন। পাশাপাশি জরিপের মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত ও সুপারিশ নেওয়া যেতে পারে। সেসব মত ও সুপারিশমালার আলোকে মন্ত্রী মহোদয় ইউজিসি ও শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসে একটি চূড়ান্ত নীতিমালা প্রস্তুত করতে পারেন।

ড. মো. কামরুল হাসান, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]