'ডেঙ্গু কোর্টে' ২০ হাজার টাকার দণ্ড

তিনি একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা। ১৯ বছর ধরে থাকেন রাজধানীর উপকণ্ঠের একটি বাড়িতে। ঘটনাটির বিবরণ এ রকম: ৪ আগস্টের বেলা তিনটা। তিনি কয়েক দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। বাসায় শয্যাশায়ী ছিলেন। কোনো এক কারণে বাসার বাইরে এসেছিলেন। কেউ তাঁকে ডাকতেই তিনি লক্ষ করেন যে তাঁর বাসার সামনে অনেক পুলিশ, গাড়িতে লোকজন, সঙ্গে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট।

সিটি করপোরেশনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে ডেকে বলেন, ‘আপনার গ্যারেজে ড্রেনের দূষিত পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর দায় আপনাকে নিতে হবে। আপনাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।’

আমরা তাঁর আদেশটি দেখলাম। এক পাতা কাগজে দরখাস্তের মতো একটা ফরম; তাতে কে কী অপরাধ করেছে এবং তার দণ্ড কী, তা একেকটি লাইনের মধ্যে লিখতে হবে (শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে)। আদেশের ফরমের ওপরের অংশে লেখা ‘বাংলাদেশ ফরম নং ২২১, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। তারপর নিচের দিকে একেকটি লাইনে ‘জেলা, উপজেলা, মামলার নম্বর, দোষী সাব্যস্ত হইবার তারিখ, প্রসিকিউটরের নাম, দোষী ব্যক্তির নাম, তার ঠিকানা, যে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইল, শাস্তির ধরন, জরিমানার পরিমাণ, অনাদায়ে কারাদণ্ডের মেয়াদ অথবা উভয় প্রকার উল্লেখ।’ এসবের নিচে ‘মামলার বিচারকারী অফিসারের স্বাক্ষর’। ২০১৩ সালে বিজি প্রেস থেকে মোবাইল কোর্টের জন্য মুদ্রিত হয়েছে কয়েক লাখ ফরম। আমাদের হাতে যেটি এসেছে, সেটির ক্রমিক নম্বর ১,৬৬,৫০৪। আদেশটিতে হাতে লেখা হয়েছে স্থা.স.সি, ২০০৯, অর্থাৎ স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯–এর অধীনে বিচার করে আদেশটি দেওয়া হয়েছে। ওই আইনের ৭, ১৩, ১৪ ও ৬১ ধারায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

আমরা দণ্ডিত ব্যক্তি ও ‘বিচারকারী অফিসার’ উভয়ের সঙ্গেই মুঠোফোনে কথা বলি। দুজনেই নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। দণ্ডিত ব্যক্তি (একজন সরকারি কর্মকর্তা) আদেশ দানকারী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে শুধু বেআইনি আদেশ দানই নয়, মানহানির লিখিত অভিযোগও এনেছেন। যদি সত্যিই দণ্ডিত কর্মকর্তা মামলা করেন, তাহলে অভিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি ‘সরল বিশ্বাসে’ দণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু মেয়রের কাছে ভুক্তভোগী যে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন, তা সঠিক হলে সরল বিশ্বাস নয়, গরল বিশ্বাসই প্রমাণিত হতে পারে।

একটি লিখিত প্রমাণ তো বিচারকারী অফিসার (ম্যাজিস্ট্রেট) নিজেই রেখেছেন। ব্যাপার হলো, পরিত্যক্ত গ্যারেজে ড্রেনের ময়লা পানি ঢুকছে। সিটি করপোরেশন আইন বলেছে, যেসব অপরাধের জন্য আইনে দণ্ডের উল্লেখ নেই, সেখানে অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। তবে এই অপরাধ যদি অনবরত ঘটে, তাহলে প্রথম অপরাধের পরে প্রতিদিনের জন্য অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা হবে।

ধরে নিই, সরকারের ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাই দোষী। কিন্তু তিনি এই প্রথমবার এই অপরাধ করেছেন। তাহলে তাঁর জরিমানা হবে ৫ হাজার টাকা। তা ছাড়া ৭ ধারায় জনপথে অবৈধ প্রবেশ, ১৩ ধারায় যত্রতত্র আবর্জনা নিক্ষেপ, ১৪ ধারায় বিপজ্জনক ব্যবসা চালানো বা ক্ষতিকর দ্রব্য জমা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর কোনোটিরই দায় দৃশ্যত ওই কর্মকর্তার নয়। এমনকি ৬১ ধারার উল্লেখ আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বিচারকারী অফিসারের আদেশটিকে। কারণ, ৬১ ধারা বলেছে, যা আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত নয়, তাকে বিধি দ্বারা চিহ্নিত করা হবে। বিচারকারী অফিসারকে প্রশ্ন করলাম, বিধি আছে কি না? তিনি উত্তরে বললেন, না।

এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারী এই বিচারকারী অফিসারকে যখন আইনের ধারাগুলো পড়ে শোনানো হলো, তখন তিনি গোড়াতে তাঁর ব্যাখ্যার পক্ষে জোর খাটাতে চাইলেন। তারপর এই প্রতিবেদকের নাম–পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রথম আলো ও এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে তিনি নমনীয় হন। একজন সরকারি কর্মকর্তার পরিচয় জেনেও তিনি কীভাবে তাঁকে গাড়িতে তুলেছিলেন জানতে চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এমনকি বলেন যে দণ্ডিত হওয়ার কারণে তাঁর চাকরিতে অসুবিধা হতে পারে।

এই ভয় দণ্ডিত সরকারি কর্মকর্তাটির আছে। তিনি বুধবার সকালে এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, তাঁর বিষয়ে লেখাটি প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে কি না। ছাপা হয়নি জানার কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি এই প্রতিবেদকে অনুরোধ করেন, লেখাটি যেন না ছাপা হয়, কারণ, তাতে তিনি চাকরিক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সেই সঙ্গে এ–ও বলেন যে অনিয়ম একটা ঘটেছে বটে, যেখানে তা ঘটেছে, সেই বাসাটি তাঁর নিজের নয়, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসস্থল। তার মানে দাঁড়াল, যে অপরাধে তাঁকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, সেটার দায় তাঁর নয়; বরং ওই সরকারি কোয়ার্টারের দেখভালকারীদের। অর্থাৎ প্রকৃত দোষী শাস্তি পাননি, পেয়েছেন নিরপরাধ ব্যক্তি।

দণ্ডিত কর্মকর্তা এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, কয়েক মাস যাবৎ সেই অব্যবহৃত গ্যারেজে ড্রেনের ময়লা পানি ঢোকার বিষয়ে তিনি ও তাঁর এক প্রতিবেশী আবাসন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। এ রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে বলে মোবাইল কোর্টের আইনে কার্যত বলা আছে, যেখানে অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাইয়ের প্রশ্ন থাকবে, সেখানে বিচার ঠিক হবে না। অপরাধী স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করলেই শুধু তাঁকে সাজা দেওয়া যাবে।

মোবাইল কোর্ট ঘিরে অনেক অভিযোগ আছে। আমরা এই ঘটনা বিশদভাবে আলোচনা করলাম এটা দেখাতে যে মোবাইল কোর্ট এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে চালানো বিপজ্জনক। উপরন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো আইন বা বিধানই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিজি প্রেসে ছাপা ওই ফরম সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।

আরও পরিহাস দেখুন। দণ্ডিত ব্যক্তি লিখেছেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত আসামির ন্যায় এভাবে মানহানি করা যায় না।’ তার মানে আমরা সমাজে এটা মেনে নিয়েছি যে যাঁরা আসামি হবেন, যাঁরা গ্রেপ্তার হবেন, তাঁদের কিছু মানহানি ঘটাই যেন স্বাভাবিক। অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কোনো অবস্থায় মানহানিকর আচরণ করা যাবে না। গত মাসে জেনেভায় জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ক্যাট) সভায় আইন ও বিচারমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, সংবিধানে অপমানকর আচরণ করা নিষিদ্ধ বলা আছে। অথচ দণ্ডিত এই সরকারি কর্মকর্তাকে জরিমানার টাকা ও মুঠোফোনটি নেওয়ার জন্য নিজের বাসায় যেতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তাঁকে জোর করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের গাড়িতে তোলা হয়েছে, যা ছিল অবৈধ গ্রেপ্তারের শামিল। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, জরিমানার টাকা পরিশোধ করে মুক্তি পেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগেছিল। বিনা পরোয়ানায় এভাবে অন্তরীণ রাখা সারা দেশে মোবাইল কোর্টের স্বাভাবিক চর্চায় পরিণত হলে আমাদের আইনের শাসনের ধারণার কী হবে?

এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারী বিচারকারী অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ওই দণ্ডিত সরকারি কর্মকর্তার ঘটনাটি তার এক সাধারণ দৃষ্টান্ত। প্রশাসনিক কর্তাদের সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা মূল বিচারব্যবস্থার ধারণা ও এর ওপর ঐতিহ্যগত আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। 

সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আবাসস্থলগুলোকে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশার উপদ্রব থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আবাসন কর্তৃপক্ষের।
নালা–নর্দমার পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আলোচ্য ওই বাড়ির ড্রেন দূষণের দায় আসলে কার, সেটিও চিহ্নিত হওয়া দরকার।

মোবাইল কোর্টের দায়িত্ব জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরও দেওয়া হোক। যাঁরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো দায়িত্ববোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু মোবাইল কোর্ট–সংক্রান্ত আইনটিই তো অগ্রহণযোগ্য। তাই হাইকোর্ট এটাকে বলেছেন অসাংবিধানিক। আমাদের ধারণা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মোবাইল কোর্টে অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারী প্রশাসন ক্যাডারের এই তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণের ঘাটতি প্রকট। সেটা দূর করা জরুরি। আইনমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এই ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কর্মের জবাবদিহি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হবে। দ্রুত কিছু একটা করুন।


মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক