ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে কে বেশি এগিয়ে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি।

বিশ্বসম্প্রদায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে পড়ে আছে। তিনি বিশ্বের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, সংখ্যালঘুদের জন্য কতটা ভয়ংকর, তা নিয়ে পণ্ডিতেরা বিস্তর বলছেন, লিখছেন। ট্রাম্পের বিতর্কিত নানান কর্মকাণ্ড ও কথার তোড়ে অন্য অনেক কিছুই আড়ালে চলে যাচ্ছে।

এই যেমন এখন ট্রাম্পের চেয়েও বিপজ্জনক এক রাজনীতিক আছেন এই বিশ্বে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ও কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিনি। নাম নরেন্দ্র মোদি। অবশ্য অনেক পশ্চিমার কাছে তিনি ‘বাদামিরঙা, শ্মশ্রুমণ্ডিত ট্রাম্প’ হিসেবেও পরিচিত।

বিশ্বের নজর ট্রাম্পের দিকে থাকায় ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি অনায়াসে তাঁর ‘লক্ষ্য’ পূরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সবশেষ তিনি তাঁর হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা কাশ্মীরিদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এখন কাশ্মীরের জনমিতি বদলে দেওয়ার পালা।

নানা দিক দিয়েই ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে মিল আছে। কেউ কেউ এই দুই নেতাকে একই চোখে দেখেন। তবে বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর মোদি।

ট্রাম্প রক্ষণশীল রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ঠিক, কিন্তু তাঁর অস্থিমজ্জায় দলের মৌলিক আদর্শের উপস্থিতি খুব কমই আছে। এ নিয়ে খোদ রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও অস্বস্তি রয়েছে। ট্রাম্প জাত ব্যবসায়ী। ব্যবসা থেকে হুট করে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে প্রেসিডেন্ট বনে গেছেন তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির চেয়ে ব্যবসাটা ট্রাম্প ভালো বোঝেন। তাঁর হাবভাব-মতিগতি দেখলেই বোঝা যায়, তিনি আসলে দেশ চালাচ্ছেন ব্যবসায়িক মডেলে।

মোদির ইতিহাস ট্রাম্পের মতো নয়। তাঁর রক্ত-মাংস, অস্থিমজ্জায় ও মগজে পাকাপাকিভাবে গেঁথে আছে হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ববাদ তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-চেতনা। প্রার্থনা। হিন্দুত্ববাদের চর্চা করতে করতে তিনি ‘সিদ্ধি’ লাভ করে তবেই রাজনীতিতে নেমেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে হাত পাকিয়ে তিনি নেমেছেন জাতীয় রাজনীতিতে। এখন তিনি দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কোটি কোটি অনুসারী আছেন। তাঁরা কট্টর হিন্দুত্ববাদী নীতি অনুসরণ করছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁদের। ইতিমধ্যে সেই চিহ্ন স্পষ্ট হতে শুরুও করেছে। এদিক দিয়ে ট্রাম্পের চেয়ে মোদি অনেক শক্তিশালী, অনেক প্রভাবশালী।

ট্রাম্পকে অশালীন, চরিত্রহীন, বর্ণবাদী, খামখেয়ালি বলে গাল দেওয়া যায়। কিন্তু মোদিকে এসব বলার সুযোগ নেই। তিনি বরং আদর্শবাদী (হিন্দুত্ববাদী), ধীর-স্থির। তিনি ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে ভয়াবহ সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তাঁর কাজ মানেই একটা উদ্দেশ্য—হিন্দুত্ববাদের প্রচার-প্রসার।

মোদি তাঁর ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছরেই ভারতের ‘চরিত্র’ অনেকটা নষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। দেশটিতে এখন অসহিষ্ণুতা তুঙ্গে। সংখ্যালঘু নির্যাতন পদে পদে। আরএসএসের মতাদর্শের বিস্তার সর্বত্র।

ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে মোদি ছড়িয়ে দিয়েছেন গেরুয়া রং। এখন রূপান্তরের পালা। মোদির একজীবনের চাওয়া কারও অজানা নয়। ভারতের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে হিন্দুত্ববাদের বীজ বুনতে চান তিনি। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তর করার স্বপ্ন তাঁর। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি নিরন্তর কাজ করে চলছেন।

ধর্মের সুড়সুড়ি ও পাকিস্তান-বিরোধিতার কলে হাওয়া দিয়ে প্রথমবারের চেয়ে বড় বিজয় নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন মোদি। তিনি এখন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। আত্মবিশ্বাসী মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই প্রথম কোপটা দিলেন কাশ্মীরে। মোদিরা অনেক দিন ধরেই তক্কে-তক্কে ছিলেন। কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এবার তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো।

বিজেপির ঘরে ঘরে এখন আনন্দ। অন্যদিকে কাশ্মীরিরা হতাশায় নিমজ্জিত। কাশ্মীর এখন আর কাশ্মীরিদের নয়। তাঁরা নিজ ভূমিতে বন্দী। রাতদিন বন্দুকের নল তাঁদের তাড়া করে। ট্রিগারে চাপ পড়লে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে।

ট্রাম্প আরেক দফায় নির্বাচিত হতে পারলেই তাঁর চাওয়া-পাওয়ার অধ্যায় শেষ। দীর্ঘ মেয়াদে তাঁর কোনো পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে মোদির পরিকল্পনা দীর্ঘ। তাঁর মাথায় ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, সামাজিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে ভারতকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার মিশনে আছেন তিনি। এদিক থেকে ভাবলে মোদির কাছে ট্রাম্প তো নস্যি!

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]