বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও চোখের জলে ঈদ

মাগুরার সুরাইয়ার কথা কি আপনাদের মনে আছে? ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই শহরে ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতার সশস্ত্র ক্যাডারদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হয়ে যে শিশুটি জন্ম নেয়, তার নাম সুরাইয়া। ওই সংঘর্ষে নিহত হন সুরাইয়ার বাবা বাচ্চু ভূঁইয়ার চাচা মোমিন ভূঁইয়া। সে সময় ঘটনাটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির কারণে নয়, এ রকম গোলাগুলি অনেক জায়গাতেই হয়। মানুষও মারা যায়। কিন্তু মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। স্থানীয় আধিপত্য ও চাঁদাবাজির বিরোধ নিয়ে শহরের দোয়ারপাড়ের বাসিন্দা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ভূঁইয়ার সঙ্গে পৌর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মেহেদি হাসান আজিবরের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় বাচ্চু ভূঁইয়া আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা বেগম ও চাচা আবদুল মোমিন গুলিবিদ্ধ হন।ওই দিন রাতেই মাগুরা সদর হাসপাতালে সংকটাপন্ন নাজমা বেগমের সিজারের মাধ্যমে গর্ভে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ কন্যাশিশুটির জন্ম হয়। এ কারণে শিশুটি স্বাভাবিক অবস্থায় বেড়ে উঠতে পারেনি। সে হাঁটতে পারে না। মায়ের কোলেই থাকে সারাক্ষণ। শিশুটির চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও মা-বাবার নেই।

তিন বছর পরও আলোচিত সেই মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই। ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর পুলিশ ১৭ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তার আগে অন্যতম আসামি পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য মেহেদি হাসান ওরফে আজিবর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান। গত বছরের ২৮ মার্চ মাগুরার অতিরিক্ত দায়রা আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করা হলেও বিচারকাজ শুরু হতে পারেনি। কেননা, ওই আদালতে ১৫ মাস ধরে বিচারক নেই। আসামিরা জামিন নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিচারকের অভাবে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারকাজ বন্ধ থাকতে পারে?

শিশু সুরাইয়ার ঘটনায় অন্তত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর আগে ও পরের অনেক হত্যা মামলার তদন্তকাজই শেষ হয়নি। যেমন ঢাকায় সাংবাদিক সাগর-রুনি, কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী আখতার ওরফে তনু, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু, নারায়ণগঞ্জে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, আইন নিজের গতিতে চলবে। কিন্তু এখানে আইন নিজের গতিতে চলছে না।

মিতু হত্যার তদন্ত ঝুলে আছে

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু হত্যা মামলার তদন্ত চার বছরেও শেষ হয়নি। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে, তা-ও কেউ বলতে পারছেন না। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে, সদর দপ্তরের নির্দেশ পেলেই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে। গত মার্চে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছিলেন, ‘প্রতিবেদনটি দ্রুত জমা দেওয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে আমি নির্দেশ দিয়েছি।’ কিন্তু তাঁর নির্দেশের চার মাস পরও রহস্যজনক কারণে অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে মিতুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তার মামলা করেন। এ মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূল আসামি মুসা ও কালু পলাতক। সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে রাশেদ ও নবী নামের দুজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, মুসার পরিকল্পনায় মিতুকে খুন করা হয়। নিহত মিতুর বাবার অভিযোগ, বাবুল আক্তার এই হত্যার সঙ্গে জড়িত।

শনাক্ত হয়নি তনু হত্যার আসামি

২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার পাওয়ার হাউসের কাছের ঝোপ থেকে কলেজছাত্রী ও সংস্কৃতিকর্মী তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে কুমিল্লাসহ সারা দেশে আন্দোলন হয়েছে। ইতিমধ্যে তিন বছর চার মাস চলে গেছে। তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তনুর পোশাকে পাওয়া তিনটি ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে সন্দেহভাজন কয়েকজন ব্যক্তির ডিএনএ মেলানো হয়। তবে কোনো ফল আসেনি। তনুর মায়ের অভিযোগ, তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। তাঁরা গরিব বলে কি বিচার পাবেন না?আলামত দেখে মনে হয়, তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

সাগর-রুনি হত্যা: ৬৭ বার সময় প্রার্থনা

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ৬৭ বার সময় চেয়েছে তদন্ত সংস্থা। সর্বশেষ ৫ আগস্ট। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে তাঁরা তাঁদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্ত দেওয়া হয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব)। আসামিদের মধ্যে দুজন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে আছেন। অন্য ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুণ, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির ও আবু সাঈদ কারাগারে আটক। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু সাড়ে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্তকাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক।

থেমে আছে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত

নারায়ণগঞ্জের তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিহত হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৬ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের পুরান কোর্ট এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় ইংরেজি মাধ্যমের মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে। দুই দিন পর ত্বকীর লাশ ভেসে ওঠে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খালে। ঘটনার দিনই ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে তিনি আটজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশ সুপারের কাছে অবহিত পত্র দেন। এরপর মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবি পুলিশকে। পরে উচ্চ আদালত মামলাটি তদন্ত করতে র‍্যাবকে নির্দেশ দেন। র‍্যাব ত্বকী হত্যায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করলেও তাঁরা সবাই এখন জামিনে আছেন। দুই আসামি সুলতান শওকত ভ্রমর ও ইউসুফ হোসেন লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন,সাবেক সাংসদ নাসিম ওসমানের পুত্র আজমিরি ওসমানের টর্চার সেলে ত্বকীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে নিশ্চল হয়ে আছে তদন্ত। ত্বকীর বাবা মনে করেন, হত্যার সঙ্গে ওসমান পরিবার জড়িত বলেই মামলার তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না।

আলোচিত সময়ে আরও বেশ কিছু হত্যার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছিল। কোনো কোনোটির বিচারও হয়েছে। তবে বেশির ভাগই বিচারের বাইরে থেকে গেছে। ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক খুন হন এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে। কিন্তু আদালতের রায়ে কেউ শাস্তি পাননি। সে সময়ে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম, ‘আবু বকরকে কেউ খুন করেনি।’ এ রকম আদালতের চোখে খুনিকে না পাওয়ার বহু ঘটনা আছে। বিশেষ করে যেসব খুনের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত, সেসব ঘটনায় খুনি শনাক্ত হয় না, কেউ শাস্তি পায় না। বিচারহীনতা সমাজে অপরাধ প্রবণতা যেমন বাড়ায়, তেমনি অপরাধীরা হয়ে ওঠে বেপরোয়া।

এর বিপরীতে কেউ কেউ নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ও পুরান ঢাকার দরজিকর্মী বিশ্বজিৎ দাস হত্যা, সিলেটে রাজন হত্যা, খুলনায় রকিব হত্যার বিচারের কথা বলবেন। কিন্তু বিচারের দু-একটি নজির তো আইনের শাসনের প্রতিফলন নয়। আইনের শাসন চাইলে প্রতিটি খুনের, প্রতিটি অপরাধের বিচার হতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে। সেটাই হতে পারে অপরাধ দমনের কার্যকর উপায়। শুধু বক্তৃতা দিলে ন্যায়বিচার কায়েম হয় না।

সামনে ঈদুল আজহা। সারা দেশের মানুষ ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে চাইবে। কিন্তু যে মা-বাবা সন্তানকে হারিয়েছেন, যেসব পরিবারের কোনো
সদস্য নিখোঁজ আছেন, চোখের জলেই তাঁদের ঈদের দিনটি কাটবে।

রাষ্ট্র হত্যা-ধর্ষণ বন্ধ করতে পারছে না, বিচার তো করতে পারে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]