মশা নিয়ে মশকরা আর প্রচারই সার!

গত বছর চিকুনগুনিয়ার চিকন ব্যথায় চিক্কুর পেড়েছিল নগরবাসী। অনেকের শরীরের প্রতিটি জয়েন্টের প্রতিটি পয়েন্টে তখন ‘অনেক জমানো ব্যথা-বেদনা’। তাঁদের কঁকানি–কাতরানি সইতে না পেরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন তখন বিদেশ থেকে গাপ্পি মাছ এনে নালা–নর্দমায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলাম, এত দিন অ্যাকুরিয়ামেই পোয়েসিলা রেটিকুলাটা প্রজাতির এই মাছ দেখেছি। পয়সা খরচ করে কাঁটাবন মার্কেট থেকে এই মাছ কেনা লাগে। রাজধানীবাসীর কী কপাল! সেই মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে নর্দমায় দেখা যাবে। তারা কিলবিল করে নগরবাসীর মনোরঞ্জন করবে। টপাস টপাস করে মশার লার্ভা খাবে। লার্ভার সঙ্গে আরও যা যা খাবে তার দুর্গন্ধযুক্ত দৃশ্যকল্প বড়জোর মনে আনা যায়; লেখা যায় না। আমরা তখন গাপ্পির গপ গপ করে লার্ভা খাওয়ার দৃশ্য স্বপ্নে দেখেছিলাম। আমাদের সে স্বপ্নে কোনো দোষ ছিল না। কি জানি কী কারণে শেষমেশ গাপ্পি ছাড়া হলো না। 

চিকুনগুনিয়ার পর এ বছর এসেছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা। পটাপট মানুষ মরছে। এডিস মশা মারার ওষুধে কাজ হচ্ছে না বলে মশারির সঙ্গে মশকরার আমদানিও বেড়ে গেছে। মেয়র থেকে মন্ত্রী, কামলা থেকে আমলা—সবাই টুকটাক মশকরা করে যাচ্ছেন। 

সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ কোনো কাজের ওষুধ না—এটা জানার পর নগরবাসী যখন মরার ভয়ে জড়সড়, ঠিক তখন সাঈদ খোকন বললেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।’ তিনি ‘দায়িত্ব নিয়ে’ ৪ আগস্ট খুবই খাটো এবং আঁটো একটি হাফ হাতার টি–শার্ট গায়ে দিয়ে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এই গেঞ্জি পরা অবস্থায় তিনি ‘দায়িত্ব নিয়ে’ এডিসের কামড় থেকে রক্ষা পেতে মসজিদের ইমামসহ সবাইকে লম্বা জামা-পায়জামা ও মোজা পরার নসিহত করেছেন। মেয়র বলেছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না। তিনি মনে করছেন, তাঁর উন্নয়নের চিত্রে কালি লেপতে সংবাদমাধ্যম ‘মিছা কথা’ প্রচার করছে। কিন্তু তিনি জানেন না, উন্নয়নের একটা বড় লক্ষণই হলো ডেঙ্গু। অর্থাৎ কোথাও ডেঙ্গু দেখা দিলে বুঝতে হবে সেখানে উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের এই লেটেস্ট থিওরি হাজির করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। তিনি গত বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জে একটি সেমিনারে বলেছেন, দেশ যে উন্নত হচ্ছে তা ডেঙ্গুর উপস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে। তাঁর ভাষ্যমতে, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি ‘এলিট শ্রেণির’ মশা। এই মশা গরিব গারাব এলাকায় থাকে না। তিনি বলেছেন, ‘ডেঙ্গু (মশার নাম ‘ডেঙ্গু’!) এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন দেশে ডেঙ্গু এসেছে।’ 

এডিস মশা যে আসলেই ‘এলিট কেলাসের’, তারা যে অভিজাত এলাকাতেই বেশি থাকে, তা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কথায়ও স্পষ্ট হয়েছে। কিছুদিন আগে তিনি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই রোগ থেকে সেরে যাওয়ার পর গত জুনে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তাঁর ধারণা, শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশন কার্যালয় এলাকা থেকেই তাঁকে এই জীবাণুবাহী মশা কামড় দিয়েছে। তিনি বলেছেন, এডিসের ভয়ে তিনি পরিকল্পনা কমিশনে যাচ্ছেন না। গত ২৫ জুলাই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ওখানে (পরিকল্পনা কমিশন কার্যালয়) বেশি মশা। এ পর্যন্ত দুবার কামড় দিয়েছে, একবার চিকুনগুনিয়া ও আবার ডেঙ্গু...এটা কি কথা হলো নাকি?...এর ভয়াবহতা আমি বুঝি। এ যন্ত্রণাও বুঝি। চিকুনগুনিয়ার পরেই আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। এ অসুস্থতা নিয়েই গত ১৩ জুন সংসদে আসি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করতে পারব। কিন্তু যা ভেবেছিলাম, বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিবেশন শুরুর আগে যখন সংসদে প্রবেশ করি, তখন থেকে পরবর্তী সাত-আট মিনিট আমি সম্পূর্ণভাবে ব্লাঙ্ক ছিলাম। কোনোরকমে গিয়ে আমার আসনে বসলাম।...মনে হচ্ছিল, আমি সিট থেকে পড়ে যাচ্ছি। তখন মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করলাম।’ 

ওই একই দিন, মানে ২৫ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকা মেডিকেল কলেজে একটি সেমিনারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বংশবিস্তারের সঙ্গে এডিস মশার বংশবিস্তার প্রক্রিয়ার একটি নিবিড় সাযুজ্য আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘আমাদের দেশে হঠাৎ করে কেন এত ডেঙ্গু রোগী? একটি সিম্পল উত্তর আমার পক্ষ থেকে, সেটা হলো মশা বেশি, এডিস মশা বেশি। সে মশাগুলো অনেক হেলদি মশা এবং সে মশাগুলো অনেক সফিস্টিকেটেড মশা। তারা শহরে, বাড়িতে থাকে, এটিই উত্তর।...সামহাউ উই কুড নট ম্যানেজ কন্ট্রোল দ্য মসকুইটো পপুলেশন। যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে...আমাদের দেশে এসে। সেভাবে মসকুইটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।’ 

অতি দুঃখে যেভাবে হাসি আসে, সেভাবেই অতি ডেঙ্গুতে এসব মশকরা আসছে। কথার কামান দাগানো ছাড়া কাজের কাজ কিছু করা হচ্ছে না দেখে মশারাও হয়তো সেই মশকরায় যোগ দিয়েছে। 

রোনাল্ড রস পরিণত বয়সে দুঃখ করে লিখেছিলেন, ম্যালেরিয়াসংক্রান্ত গবেষণার জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে, সম্মান-সমাদরের অন্ত নেই, শুধু মশা তাড়ানোর জন্য তিনি যা যা করতে বলেছেন, তার কিছুই করা হয়নি। 

রোনাল্ড রসের কথামতো কিছু করা হয়নি বলেই ধর্মগ্রন্থ থেকে পুরাণ, কবিতা থেকে উপন্যাস, যাত্রা থেকে থিয়েটার, হোয়াইট হাউস থেকে বঙ্গভবন, নিউইয়র্ক থেকে ভূতের গলি, আগরতলা থেকে খাটের তলা—সবখানে মশা আছে। মশার বিনাশ নেই। সে মৃন্ময়। সে চিন্ময়। সে অজর অমর অক্ষয়। সে অব্যয়! সে মানব, দানব, দেবতার ভয়। 

তবে ডেঙ্গুগ্রস্ত মানুষের মর্মন্তুদ আর্তনাদ ও তাঁদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া দেখেও মশকরা করার মতো অল্প কিছু লোক আছেন, যাঁরা মশাকে ভয় পান না। তাঁদের কথা আলাদা। 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক