পেনশন-বৈষম্য দূর করা জরুরি

সপ্তাহ দুই আগে প্রথম আলোর চিঠিপত্র কলামে একজন অবসরজীবী লিখেছেন, তিনি অবসরে যান ১৯৮৫ সালে। বেতন স্কেলে সপ্তম গ্রেডের শেষ প্রান্তে ছিলেন তখন। সে সময়ের প্রাপ্ত বেতনের আলোকে নির্ধারিত হয় পেনশন। সময়ে সময়ে বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে কিছু পেনশন বৃদ্ধিও জুটেছে তাঁর ভাগ্যে। এখন ৯২ বছর বয়সে পেনশন পাচ্ছেন ৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। তাঁর ছেলেও একই গ্রেডে চাকরি করে অবসরে গেছেন ২০১৬ সালের ৩০ জুন। এখন বয়স ৬২। তিনি পেনশন পাচ্ছেন ৩১ হাজার ৪৫৯ টাকা। বিষয়টি কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে যাঁরা পেনশনজীবী, তাঁরা এ ধরনের বিয়োগান্ত অনেক নাটকের সঙ্গেই পরিচিত। এমনকি ২০০৯ সালের বেতন স্কেল দেওয়ার আগে যাঁরা সর্বোচ্চ স্তরের চাকরি থেকে অবসরে গেছেন, তাঁদের পেনশন হালের বেতন স্কেলের নবম গ্রেডের সদ্য যোগদানকারী একজন নবীন কর্মকর্তার মূল বেতনের চেয়েও কম। 

এ বৈষম্য বারবার তুলে ধরা হয়েছে। দাবি জানানো হয়েছে, একই পদ থেকে যাঁরা অবসরে গেছেন বা যাবেন, তাঁদের পেনশনও সমান হবে। বলা হয়, নিয়ম নেই। খুবই সত্যি কথা। আর এ জন্যই তো নিয়ম করার দাবি। কর্মরত চাকুরেদের অনেক সুবিধাদি কয়েক বছর আগেও ছিল না। নিয়ম করেই সেগুলো তাঁরা নিচ্ছেন। নিয়ম তো অচলায়তন নয়। আর এ পেনশন-বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে সরকার চাকরিজীবীদের বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর। এ দুটি স্কেলে বড় ধরনের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। সরকারের আর্থিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছাও কাজ করেছে এর পেছনে। কিন্তু পেনশন বৃদ্ধির পুরোনো সূত্রটাই রয়ে গেছে। তাই পেনশনধারীদের একটি অংশ এর শিকার হয়ে হতশ্রী জীবন যাপন করছেন। 

যাঁর চিঠিটি দিয়ে লেখাটি শুরু, তিনি তো আয়ের নিরিখে মধ্যবিত্ত স্তর থেকে নিচে নেমে গেলেন। এরূপ ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। অথচ এ বৈষম্য নিরসন সম্ভব ও সমীচীন। এর জন্য খুব বেশি পরিমাণ টাকা আবশ্যক হবে, এমনও নয়। এককালীন পেনশন সমর্পণকারীদের ১৫ বছর পর পুনর্বহালের মানবিক সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে কেউ কেউ গেল গেল রব তুলেছিলেন। অথচ দেখা গেল এতে সরকারের বার্ষিক ব্যয় বেড়েছে দেড় শ কোটি টাকা। এ টাকাটা কি বর্তমান বাজেটের আকৃতিতে অতি সামান্য নয়? কার্যত তাঁরা ১০০ মাসের সমপরিমাণ টাকা নিয়ে পেনশন সমর্পণ করেছিলেন। পুনর্বহালের মেয়াদটি ১৫ বছর অনেক বেশি হয়ে গেছে। এত দিন বাঁচেন কজন! এ মানবিক সিদ্ধান্তটি আরেকটু প্রসারিত করে একে ১০ বছরে নিয়ে এলে রাজকোষে তেমন বেশি চাপ পড়বে না। পেনশনধারী বাড়ছেন। বাড়ছে তাঁদের দাবি। আবার ক্রমান্বয়ে তাঁরা মরে গিয়ে সরকারকে দায়মুক্তিও দিচ্ছেন। এ ধরনের পুনর্বহালের তো কোনো আইন বা বিধি ছিল না। ছিল সরকারের সদিচ্ছা। তাই নতুন নিয়ম করা হয়েছে। 

ঠিক তেমনি একই পদে একই পেনশনের ধারণাটিও অভিনব নয়। ভারতে এ নিয়ে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আইনি লড়াইয়ে নামেন। দীর্ঘদিন চলে মামলা। একপর্যায়ে ভারত সরকার ২০১৮ সালের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে দেয়, অবসরপ্রাপ্ত সব মেজর জেনারেল বা তাঁদের সমমানের সামরিক কর্মকর্তারা অবসরের সময়নির্বিশেষে একই পরিমাণ পেনশন পাবেন। সিদ্ধান্তটি সব মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। সবাই আশা করছেন, অন্যান্য পদ-পদবি থেকে যাঁরা অবসরে যাবেন, কালক্রমে তাঁরাও আসবেন এ সুবিধার আওতায়। এ মর্মে কিছু প্রস্তুতিও চলছে বলে জানা যায়। 

আর বিষয়টি তো নৈতিক বা মানবিক কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। অবসরজীবীরা প্রাপ্ত সুবিধাদির কিছুই চান না। যাঁরা যখন চাকরিতে থাকবেন, তাঁরাই এর সুফলভোগী হবেন। এর ক্রমসম্প্রসারণ ঘটছে আর্থিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি। তবে যাঁরা অবসরে গেছেন বা যাবেন, তাঁদেরও একইভাবে মূল্যস্ফীতির খেসারত দিতে হচ্ছে। করের জালে তাঁদের প্রকৃত আয়ও যাচ্ছে কমে। এখানে প্রচলিত বিধিতে একই গ্রেড থেকে বিভিন্ন সময়ে অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীদের পেনশন-বৈষম্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

এর বিষয়াদি জোরালোভাবে সামনে আসে কিছু কারণে। প্রথমত, পেনশন নেওয়ার সময়ে অনেকেই আশা করেছিলেন, এককালীন সমর্পিত অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মুনাফা অবসর জীবনযাপনে সহায়ক হবে। বছর দুয়েক আগে সে মুনাফা অন্তত ২ শতাংশ হারে কমানো হয়েছে। এবার বাড়ানো হয়েছে মুনাফার ওপর আয়কর। এতে কমে গেছে প্রত্যাশিত আয়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবও পড়ছে। এ আয়বৈষম্য মধ্যবিত্তের ভিতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়টিকে আরও জটিল করা হয় বেতন বৃদ্ধির সময়ে পেনশন বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করাকালীন। ২০১৫ সালে বেতন বৃদ্ধি হয় প্রায় শতভাগ। আর পেনশন বাড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। 

বলা হয়, অর্ধেক টাকা তো সে চাকরিজীবীরা আগেই সমর্পণ করে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সে টাকা কত টাকা! সে অতি কম বেতনের শতকরা ৮০ ভাগ ছিল পেনশন। এখন এটাকে ৯০ শতাংশ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যের খাতিরে বলতে হয় এখানে রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো নেতিবাচক ভূমিকা থাকে না। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাই বস্তুতপক্ষে এটা চূড়ান্তকরণে মূল ভূমিকা রাখেন। তাঁদের কাছে পুরোনো পেনশনধারীদের দাবি গুরুত্ব পেল না কেন, এটা দুর্বোধ্য। আর হাল আমলের সরকারি বাজেটের অগ্রাধিকারে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নেই। বরং তাদের ব্যয় গেছে বেড়ে। তাই এ বৈষম্য নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। 

যাঁরা চাকরি থেকে অবসরে যান, পরবর্তী সময়ে চাকরিজীবীদের নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হলে তাঁরাও পুলকিত হন। সমর্থন করেন এসব সুবিধা। কিন্তু কখনো নিজেদের জন্য এগুলোর কোনোটি দাবি করেন না। তেমনি ১৯৮৫ সালে অবসরে যাওয়া পিতা তাঁর পুত্রের বেতন ও সুবিধাদি সময়ে সময়ে বৃদ্ধির কথা জেনে পুলকিত হয়েছেন। ছেলে ভালো চলতে পারছেন দেখে হয়েছেন তৃপ্ত। কিন্তু উভয়ে যখন চাকরি থেকে অবসর নিলেন, তখন তো এক স্তরেই থাকার কথা। বলা হবে, বিধি মেনেই পেনশন নির্ধারিত হয়েছে। তবে এ ব্যবস্থাটির নৈতিক দিক গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এর সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। আর রাষ্ট্রের বিধি কেন, আইন, এমনকি সংবিধান সময়ের দাবির সঙ্গে সংগতি রেখে সংশোধন করা হয়। এ পেনশন নির্ধারণসংক্রান্ত বিধিবিধান সংশোধনও সময়ের দাবি। 

সরকারি চাকরিজীবীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ। তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি গত ১০ বছরে সরকার খোলা হাতে বাড়িয়ে চলছে। ফলে সরকারি চাকরিতে যোগদানে ইচ্ছুক মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ বাড়ছে। এটা সরকারব্যবস্থা জোরদারকরণে ক্রমান্বয়ে সুফল রাখবে। সেই চাকরিজীবীরাই সময়ান্তরে অবসরে যান। তাঁরা দেশকে গোটা কর্মজীবনে শ্রম ও মেধা দিয়েছেন। অবসরজীবন স্বীকৃতভাবে বার্ধক্য। সে বার্ধক্যে তাঁরা শুধু শারীরিকভাবে নয়, বিভিন্নভাবে অসহায় হয়ে যান। সে সময়ে যদি অবশিষ্ট জীবনযাপনের জন্য অর্থের সংস্থানে শোচনীয় অপ্রতুলতা থাকে ও নির্ভরশীল হতে হয় অন্যের, তাহলে সে অসহায় অবস্থা আরও বাড়ে। বৃহত্তর পরিবার ও সমাজেও থাকেন তাঁরা উপেক্ষিত। এ অবস্থা থেকে যথেষ্ট পরিত্রাণ দিতে পারে পেনশন নির্ধারণ পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার। 

একই স্কেল থেকে অবসর নেওয়া সব চাকরিজীবী একই হারে পেনশন পাবেন—এ মৌলিক নীতিটি নিয়ে বিধি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া যায়। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে সন্দেহ নেই। তবে বকেয়া না দিয়ে কিংবা বৃদ্ধিটি দুই ধাপে করা হলে ব্যয়ের চাপ কমে যাবে। সরকারের ব্যয় তো প্রতিবছরই বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে আয়। আর এ ব্যয় মধ্যবিত্তের ভিতকে কিছুটা শক্তিশালীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নবতিপর পিতা ৩৪ বছর আগে অবসর গ্রহণের কারণে হালে একই পদ থেকে অবসর নেওয়া পুত্রের পেনশনের মাত্র ১৪ শতাংশ পেয়ে জীবনযাপনের গ্লানি থেকেও পাবেন মুক্তি।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব