স্তালিনকে 'উপড়ে ফেলা' যায়নি

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যাহীন বিবরণ, একপেশে অসম্পূর্ণ তথ্য, মনগড়া সংবাদ ও অজ্ঞতা, অযৌক্তিক আবেগের সুড়সুড়ি দেওয়া নাম ভাঙানোর (পাঠককে মোহিত করতে অকারণে এরেনবুর্গ ও গ্রামসির নামোল্লেখ) বৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে বাহ্যিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টায় লেখা হাসান ফেরদৌসের ‘স্তালিনবাদকে যাঁরা জিন্দাবাদ দিচ্ছেন’ উপসম্পাদকীয়টি (প্রথম আলো, ২১ জুলাই ২০১৯) সম্পর্কে আলোচনা জরুরি। এতে কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য ধরে বিস্তারিতভাবে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন জরুরি হলেও এখানে মূলত হাসান ফেরদৌসের লিখিত স্তালিন সম্পর্কে মনগড়া ও অজ্ঞতাপ্রসূত (ইচ্ছাকৃত কি?) ভিত্তিহীন মন্তব্য, ‘মহাপরাক্রমশালী সেই কমিউনিস্ট নেতার প্রায় সব মূর্তি উপড়ে ফেলা হয়েছে’ বিষয়ে এই ভিন্নমতে সাম্প্রতিক সত্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

যে আত্মপ্রসাদ ও শ্লেষ নিয়ে হাসান ফেরদৌস স্তালিনকে ‘উপড়ে ফেলা’ হয়েছে বলে লিখেছেন, মনগড়া সংবাদ ও অজ্ঞতাজাত ভিত্তিহীন কথা। ‘দানব স্তালিন’কে মুছে ফেলার সুসমাচারটি সঠিক হলে খুশি হওয়া যেত। কিন্তু মার্কিন পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস (৩০.৬.১৯) ও ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট (২১.১১.২০১৭) ভিন্ন সংবাদ দিয়েছে। বিলেত-আমেরিকা-ইউরোপের বিশিষ্ট আরও সংবাদমাধ্যমেও অনুরূপ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে এক দশকের মতো সময়ে। ‘আ মনস্টার টু হিস্ট্রি, স্তালিন ইজ আ ট্যুরিস্ট ম্যাগনেট ইন হিজ হোম টাউন’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, স্তালিনের জন্মস্থল জর্জিয়ার গোরিতে (তাঁর পৈতৃক ভিটার পাশেই) ১৯৫৮ সালে স্থাপিত ‘স্তালিন জাদুঘর’ নিস্তালিনীকরণের আক্রোশ এবং এটিকে বন্ধ করার সাম্প্রতিক চেষ্টা উপেক্ষা করে (ইনডিপেনডেন্ট–এর ভাষ্য) মহাসমারোহে স্তালিনের অমর কীর্তিসমূহের ইতিহাস তুলে ধরছে। গত বছরই ১ লাখ ৬২ হাজার দর্শনার্থী (বড় অংশ রাশিয়া ও চীন থেকে আগত) এসেছেন এই জাদুঘরে। ইনডিপেনডেন্ট দুঃখিত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, ‘লক্ষণীয়ভাবে জাদুঘরটির মূল ফ্লোরে একনায়কের খুনখারাবির অতীত ও নীতিসম্পর্কিত কিছুর উল্লেখ নেই।’

স্তালিনের জন্য ভালোবাসা আর মর্যাদার সাক্ষী হয়ে উঠেছে জাদুঘরের গাইডদের বিবরণ ও প্রদর্শনীর উপাদানগুলো। কম্বোডিয়ার ‘জেনোসাইড মিউজিয়াম’ ও শহরের আরেক প্রান্তে প্রকৃত বধ্যভূমিস্থ প্রদর্শনীস্থলের সঙ্গে পত্রিকাদ্বয়ে বর্ণিত স্তালিন জাদুঘরের বিবরণটি মিলিয়ে দেখে উপস্থাপনাগত পার্থক্য এবং স্তালিনের উদ্দেশে প্রদত্ত সম্মান ও মমত্বের তফাতটি তুলনীয় হতে পারে। এ ধরনের সংবাদে অবধারিতভাবে ব্যবহৃত ‘স্বৈরশাসক’, ‘একনায়ক’, ‘খুনি’, ‘নিষ্ঠুর’ ইত্যাদি ‘বস্তুনিষ্ঠ’ বিশেষণের দিকে একটু সতর্ক নজর রাখা—ইংরেজিতে যাকে বলে বিটুইন দ্য লাইন পড়া—দরকার পড়ে।

স্তালিনকে ‘উপড়ে ফেলা’ নিয়ে অজ্ঞতা দূর হবে দুটি জরিপের ফলাফল থেকে। ২০১৭ সালে পরিচালিত এক জরিপে ৩৮ শতাংশ রুশ স্তালিনকে তাদের দেশের অসাধারণ ১০ জন মানুষের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন (নিউজউইক ২৬.৬.২০১৭)। আর ২০১৯ সালের এক জরিপে দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখায় জনপ্রিয়তার হার উন্নীত হয়েছে ৭০ শতাংশে (দ্য টেলিগ্রাফ, ১৬.৪. ২০১৯)। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের এক জনমত জরিপে স্তালিনের পক্ষে ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

ঘুম হারাম করার মতো আরও সংবাদ যুক্ত হয়েছে টেলিগ্রাফ–এর বিবরণে: সাইবেরিয়ার অন্যতম বড় শহর নভোসিবির্স্কে স্তালিনের মূর্তি স্থাপন করা হবে এবং সেখানকার একটি গ্রামের প্রধান ইতিমধ্যে গ্রামের ২৫টি রাস্তাকেই সংখ্যা দিয়ে পৃথক করে সব কটির নামকরণ করেছেন স্তালিনের নামে!

উল্লিখিত গুটিকয়েক প্রতিনিধিত্বমূলক সংবাদেই ‘উপড়ে ফেলা’র ভিত্তিহীন কাহিনির শেষ নয়। সোভিয়েত সরকার ও পার্টির মহাফেজখানা উন্মুক্ত হলে অনেক গবেষকের মতোই ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেসের ‘অ্যানালস অব কমিউনিজম সিরিজ’–এর গবেষক জোনাথন ব্রেন্ট ১৯৯২ সালে স্তালিনের ব্যক্তিগত মহাফেজখানা নিয়ে গবেষণার (ইনসাইড দ্য স্তালিন’স আর্কাইভস: ডিসকভারিং দ্য নিউ রাশিয়া) জন্য রাশিয়া গিয়েছিলেন। স্তালিন, রাশিয়া, সেখানকার মানুষের আচরণ ও মানসিকতা নিয়ে তাঁর বিস্ময় ও বিচলিত হওয়ার কিছু বিবরণ আছে ২০০৯ সালে লেখা বইটির মুখবন্ধেই (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৩. ১.২০০৯): ওই বছরেরই কাছাকাছি সময়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাঁকে বলেছিলেন, ‘না। স্তালিনের আর ফিরে আসা অসম্ভব। এটা হবে হিটলারের ফিরে আসার মতো অসম্ভব।’ কিন্তু তিনি রাশিয়ায় দেখেছেন ভিন্ন চিত্র—মস্কোর শেরেমেতোভা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপে স্তালিনের ছবিসংবলিত প্যাকেটে চকলেট বিক্রি হচ্ছে। জোনাথন লিখেছেন, ‘সরকারি দালানগুলো থেকে দীর্ঘকাল আগে অপসারিত হলেও স্তালিনের নাম ও তাঁর বাণী সাধারণ মানুষের মুখে রয়ে গিয়েছে এবং প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে এখনো দেখা যায় তাঁর আবক্ষ বা পূর্ণ মূর্তি।’

বিরোধীদের কুৎসা এবং ব্যক্তির অন্ধ বিদ্বেষের ওপর ইতিহাস, জনগণের স্মৃতি ও বিচারবুদ্ধি যে নির্ভর করে না, প্রদত্ত বর্ণনাগুলো তারই প্রমাণ। স্তালিনের নেতৃত্বে ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ দেশ রাশিয়া জেগে উঠে রূপান্তরিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশে; যে দেশকে আঁতুড়ঘরে পিষে মারতে জোট বেঁধে তিন বছরব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল আমেরিকাসহ চৌদ্দটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ, ভেতরে ছিল দীর্ঘ সময়ব্যাপী জোটবদ্ধ শত্রুর সঙ্গে গৃহযুদ্ধ ও লাগাতার অন্তর্ঘাত, প্রতিষ্ঠার ষোলো বছর পর মার্কিন স্বীকৃতি প্রাপ্তি দেশটির প্রতি বৈরিতার তীব্রতাকেই নির্দেশ করে।

এ পরিস্থিতি রাশিয়াকে জার আমলের চেয়ে বেহাল অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। লেনিন ও স্তালিন পৃথিবীর দুয়ারে ঘুরেছেন কখনো দেশের সম্পদ বিক্রি করে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ের জন্য, কখনো বিনিয়োগকারীর সন্ধানে। সহযোগিতা মেলেনি। শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে কয়েক শ বছর পিছিয়ে থাকা রাশিয়াকে দুই দশকের কম সময়ে স্তালিন উন্নীত করেছিলেন শিল্পোন্নত দেশের সারিতে। দেশকে দিয়েছিলেন উন্নত কৃষিব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আবাস-সমতা-মর্যাদা। সামরিক প্রস্তুতি, বিচক্ষণতা আর শক্তিতে সমগ্র সোভিয়েতবাসীকে সমবেত করে সর্বোচ্চ জীবনদানের বিনিময়ে হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দানবকে হটিয়ে পৃথিবীকে নিরাপদ করেছিলেন। সার্বক্ষণিক প্রতিবন্ধকতার মুখে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ কোনো ভুলত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া সম্পন্ন করা হয়তো কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিবেশ, অবিচল আদর্শনিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ আর নিজস্ব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি তো মানুষ ছিলেন—এটাই বিবেচনার কথা। ত্রুটিবিচ্যুতির রাশিয়া ও বিশ্বের জন্য তাঁর রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক অবদানের কথাই আজও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বহু মানুষের চেতনা ও স্মৃতিতে জাগরূক আছে। তাই স্তালিনের মৃত্যুর পর প্রাভদা পত্রিকায় ইলিয়া এরেনবুর্গ সঠিকভাবে যা লিখেছিলেন, তা আজও সত্য—‘স্তালিন জীবিত!’ এ কারণেই স্তালিনকে উপড়ে ফেলা যায়নি আজও। জিন্দাবাদের নাড়া জোসেফ স্তালিনেরই প্রাপ্য ন্যায়সংগতভাবে।

ওমর তারেক চৌধুরী লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক
[email protected]