গবাদিপশুর মাংস খেলে ডেঙ্গু হয় না

গবাদিপশুর মাংস খেলে ডেঙ্গু হবে কি? এমন একটি প্রশ্ন অনেকের মাথায় উঁকি দিচ্ছে। একজন ভেটেরিনারিয়ান ও মশা গবেষক হিসেবে আমি বলতে পারি, এটি খুবই অমূলক একটি ধারণা।

ডেঙ্গু হচ্ছে মানুষের একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীতে খুব কম হয়। ননহিউম্যান প্রাইমেটস, যেমন: বানর, বনমানুষ—এদের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস রেপ্লিকেট বা প্রতিলিপি তৈরি করতে পারলেও ক্লিনিক্যাল ডিজিজ তৈরি করতে পারে না। থাইল্যান্ডে ২০১৭ সালে কুকুরের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা গেলেও কুকুর ডেঙ্গু ভাইরাসের রিজার্ভার হিসেবে কাজ করতে পারে কি না—বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নন।

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিক্টাস নামক দুটি মশার প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গু ছড়ায়। এর মধ্যে এডিস এজিপ্টিকে বলা হয় আরবান মসকুইটো বা শহুরে মশা। একে ডোমেস্টিক মসকুইটো বা গৃহপালিত মশাও বলা হয়। ফলে, এডিস এজিপ্টি প্রজাতির মশাগুলো মানুষকেই কামড়াতে পছন্দ করে বা কামড়ায়। এটাকে বলা হয় এনথ্রোপোফিলিক বিহেভিয়ার। অন্যদিকে, এডিস এলবোপিক্টাসকে বলা হয় রুরাল মসকুইটো বা গ্রাম্য মশা। তাদের ফরেস্ট মসকুইটো বা বন্য মশাও বলে। এই প্রজাতির মশারা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বদ্ধ স্বচ্ছ পানির উৎস, যেমন: গাছের গুঁড়ি, কাটা বাঁশের গোড়া, ভাঙা রাস্তা, বদ্ধ স্বচ্ছ ডোবা ইত্যাদিতে বংশবৃদ্ধি করে। গ্রামে বা বনে থাকে বলে এডিস এলবোপিক্টস মশাগুলো মানুষসহ অন্য প্রাণীদেরও কামড়ায়। অর্থাৎ, এরা এনথ্রোপোফিলিক (মানুষের প্রতি আকৃষ্ট) ও জুওফিলিক (প্রাণীদের প্রতি আকৃষ্ট) উভয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এডিস মশা গৃহপালিত পশুদের কামড়ালে তাদেরও ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে কি না বা পশুর মাংস খেলে তা মানুষে ছড়াতে পারে কি না।

এখন পর্যন্ত কোনো গৃহপালিত পশু, যেমন: গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ বা ঘোড়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা যায়নি। তা ছাড়া কোনো পশুর মাংস খেয়ে ডেঙ্গু হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, একমাত্র স্ত্রী এডিস মশার কামড়েই ডেঙ্গু ছড়ায়।

কীভাবে এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়? ডেঙ্গু রোগের ভাইরেমিক পর্যায়ে কোনো এডিস মশা রোগীকে কামড়ালে সেই মশা সংক্রমিত হয়। মশার পাকস্থলীতে ভাইরাসটি রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরি করে। এরপর মশার পাকস্থলী থেকে ভাইরাসটি মশার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে মশার সেলাইভারি গ্ল্যান্ড বা লালাগ্রন্থিতে পৌঁছায়। আক্রান্ত মানুষ থেকে রক্ত খাওয়ার পর ডেঙ্গু ভাইরাস মশার লালাগ্রন্থিতে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী সময়টুকুকে এক্সট্রিনসিক ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়। এই এক্সট্রিনসিক ইনকিউবেশন পিরিয়ড সম্পূর্ণরূপে তাপমাত্রানির্ভর। সাধারণত, এই পিরিয়ড সম্পন্ন হতে ৮ থেকে ১২ দিন সময় লাগে, তবে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এর সময় কমতে থাকবে। তবে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মশার ভেতরে এই ইনকিউবেশন পিরিয়ডের গড় সময়কাল সাড়ে ছয় দিন। অর্থাৎ, একজন সংক্রমিত মানুষের শরীর থেকে রক্ত খাওয়ার পর আরেকজন মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ছড়াতে এডিস মশার গড়ে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে।

তাই কোনো বিভ্রান্তি নয়, কোরবানির পশুর মাংস খেতে কোনো বাধা নেই। ডেঙ্গু রোগ এবং এর বাহক এডিস মশা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে এডিস মশা ও ডেঙ্গু দুই-ই নির্মূল সম্ভব।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার রোধ করতে হবে এবং মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এডিস মশা নিধনের জন্য সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে দুটি দিক অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, মশার প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, বয়স্ক মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

মশার প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস করতে হলে বাড়িতে এবং আশপাশে বদ্ধ বা জমানো পানির পাত্র দু-এক দিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোল, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে লার্ভানাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে, বয়স্ক মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু রাস্তায় ফগিং বা ধোঁয়া ছড়ালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে না। কারণ, এডিস মশা সাধারণত ঘরের ভেতর জন্ম নেয় এবং বিশ্রাম নেয়। তাই ঘরের ভেতরে স্প্রে করতে হবে, যাতে ঘরের ভেতরের মশা মারা যায়।

দেশের এই দুর্যোগময় সময়ে ঘরের ভেতরে ও বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনবোধে বিশেষ ফোর্সের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সময় বেঁধে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমন্বয় প্রয়োজন। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রথমে প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুরক্ষা।

পরিবারের লোকজনকে যাতে মশা না কামড়ায়, তার জন্য মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। দিনের বেলায় ঘুমালে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। শরীর কাপড় দিয়ে যথাসম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে যাতে কোনো মশা কামড়াতে না পারে, সেদিকে অবশ্যই সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, আক্রান্ত রোগীই ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ন্যাশনাল গাইডলাইন থাকতে হবে। সরকারকে বিদেশ থেকে উলবাচিয়া আক্রান্ত বা জেনেটিক্যালি মোডিফাইড মশা আমদানি করা বা বিশেষ ফোর্স কাজে লাগানোর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের এই দুর্যোগের মুহূর্তে বিচলিত না হয়ে সবাই একযোগে কাজ করলে অবশ্যই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

অধ্যাপক ড. তাহসিন ফারজানা: বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ