মন্ত্রীর দুঃখপ্রকাশ ও সচিবের 'শিক্ষা নেওয়া'

শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে ট্রেন দেরিতে ছাড়ছে। রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। কমলাপুর স্টেশন, ঢাকা, ১১ আগস্ট। ছবি: হারুণ আল রশীদ
শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে ট্রেন দেরিতে ছাড়ছে। রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। কমলাপুর স্টেশন, ঢাকা, ১১ আগস্ট। ছবি: হারুণ আল রশীদ

সিলেট থেকে রোববার দুপুরে এক বন্ধুর টেলিফোন পেলাম। তিনি এক দিন আগে ঢাকা থেকে সিলেটে ছুটিতে কাটাতে গেছেন এই রুটে তুলনামূলক যানজট কম বলে। তাঁর ইচ্ছে ছিল সিলেটে আনন্দে ঈদের ছুটিটা কাটাবেন। কিন্তু গতকাল টেলিফোনে বললেন, ঢাকা থেকে সিলেট যেতে ৯ ঘণ্টা লেগেছে, যদিও স্বাভাবিক সময়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। ঢাকায় বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখেন তাঁদের নির্ধারিত বাস সিলেট থেকে আসেনি। বাস ছাড়ার সময় ছিল রাত ১২টা। বাস এল পৌনে ২টায়। ঢাকা থেকে ২টায় বাস ছেড়ে সিলেট পৌঁছেছে সকাল ৯টায়।

সিলেটে অনেক পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু কোনো কোনোটির সড়ক এতই বেহাল যে ভ্রমণের আনন্দ পথেই শেষ। সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দি যাওয়ার সড়ক ভাঙাচোরা। ঈদের ছুটিতে ছুটে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের এবারও যাতায়াতের বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। সিলেট শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ২৬ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে সড়কপথে আধা ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু সড়কের কিছু অংশে ভাঙাচোরা থাকায় পৌঁছতে লাগে দুই ঘণ্টা।

এরপরও সিলেটে যাওয়া বন্ধু নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কেননা অন্যান্য রুটে যে মহাযানজট লেগেছে, তা কল্পনার অতীত। ঈদের আগে মন্ত্রীরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, এবারের ঈদে রাস্তাঘাট ঠিক আছে। কোনো যানজট হবে না।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস-ট্রেন সব পথেই যানজট। পথে পথে মানুষের বিড়ম্বনা। ঈদযাত্রায় উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বাসযাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। রোববার কল্যাণপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সড়কপথে বেহাল অবস্থার কারণে কে কখন বাড়িতে পৌঁছাতে পারবেন, জানেন না। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কল্যাণপুর বাস টার্মিনালে বেলা সাড়ে ১১টায় কয়েকজন যাত্রী বিরক্ত হয়ে চড়াও হচ্ছিলেন একটি পরিবহনের কাউন্টারে। শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় তাঁদের বাসের টিকিট নির্ধারিত ছিল। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সে গাড়ি ঢাকায় না ফেরায় যাত্রীদের রাতভর বসে থাকতে হয়েছে কাউন্টারে। একপর্যায়ে পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা হস্তক্ষেপ করে যাত্রীদের নিবৃত্ত করেন।

ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানজটে আটকে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ছবিটি বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়ক থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানজটে আটকে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ছবিটি বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়ক থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

ট্রেনের অবস্থা আরও শোচনীয়। রোববার দুপুরে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল গিজ গিজ করছে মানুষ। ট্রেনের জন্য শনিবার রাত থেকে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছিলেন। পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস আসতে মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। একজন দৌড়ে যেতে যেতে তাঁর সহযাত্রীকে বলছেন, ‘আমাকে তুই টেনে তুলিস।’ টেনে তোলা মানে ছাদে জায়গা পাওয়া। আরেকজন বললেন, ‘এ তো ট্রেন নয় উইয়ের ঢিবি।’ বগির ভেতরে যত মানুষ তার চেয়ে কয়েক গুণ মানুষ ছাদের ওপর।

রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেসের ছাড়ার কথা ছিল শনিবার রাত ১১টা ১০ মিনিটে। ট্রেনটি রোববার বেলা ১১টার পরে ছেড়েছে। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস রোববার সকাল ছয়টায় ছাড়ার কথা ছিল। ট্রেনটি ছাড়ার সম্ভাব্য কোনো সময় জানানো হয়নি। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস আজ সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সম্ভাব্য সময় জানানো হয়েছে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে। চিলাহাটিগামী সকাল আটটার নীলসাগর এক্সপ্রেস ছাড়ার সম্ভাব্য কোনো সময় জানানো হয়নি, বলা হয়েছে বিলম্ব হবে। রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২টার দিকে তা ছাড়তে পারে।

রেলসচিব মোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, নতুন ট্রেন যোগ হওয়া, ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়া ও বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেনের ধীরগতির কারণে শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হবে। চিত্রা, লালমনি ও পদ্মা এক্সপ্রেসে অতিরিক্ত বিলম্ব হয়েছে। বিকল্প পথে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মানুষ যখন চরম দুর্ভোগে পড়েন তখন মন্ত্রী-সচিবেরা তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের কথা বলেন। কিন্তু সময় পার হলে আবার ভুলে যান। আবার ঈদ-পার্বণ না আসা পর্যন্ত তাঁদের ঘুম ভাঙে না। এভাবেই বছর পার হয়ে যায়। মন্ত্রী বদলায়। সচিব বদলায়। মানুষের দুর্ভোগ কমে না। আরও বাড়ে।

ঈদে যে করেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। ফিরতে হবে মায়ের কাছে, স্বজনদের কাছে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই ট্রেনে যাত্রা করছেন ঘরমুখী মানুষ। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ১১ আগস্ট। ছবি: হাসান রাজা
ঈদে যে করেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। ফিরতে হবে মায়ের কাছে, স্বজনদের কাছে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই ট্রেনে যাত্রা করছেন ঘরমুখী মানুষ। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ১১ আগস্ট। ছবি: হাসান রাজা

এবারের ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি বেশি হয়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টাঙ্গাইলের অংশে যানজটে আটকা পড়া যাত্রীরা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় আগুন জ্বেলে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফা এভাবে টোল আদায় বন্ধ রাখায় সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও যানজটের মাত্রা একেবারে কম নয়।

মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের কারণে ঈদের ছুটিতে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, বিকেল থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

গতকাল ফরিদপুরের মধুখালী থেকে আমাদের এক সহকর্মী ঢাকায় এসেছেন সাড়ে ১০ ঘণ্টায়। মধুখালী থেকে ফেরিতে লেগেছে দুই ঘণ্টা। এরপর পাটুরিয়া থেকে মানিকগঞ্জ পৌঁছাতে লেগেছে ছয় ঘণ্টা। আর মানিকগঞ্জ থেকে গাবতলী আড়াই ঘণ্টা। আরেক সহকর্মী ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকা থেকে সকাল ৬টায় রওনা হয়ে রাত ১২টার সময়ও বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এটাও যদি মন্ত্রীরা যানজট না বলে ‘ধীরগতিতে গাড়ি চলা’ বলেন, তাহলে বাংলা অভিধানে শব্দটির অর্থ বদলে দিতে হয়। পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে, মন্ত্রী-সচিবেরা প্রতি ঈদে একই কথা বলছেন, একই আশ্বাস দিয়ে চলছেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন, বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। তাদের একটা কিছু বুঝ দিলেই চলবে। কিন্তু মানুষের স্মৃতিশক্তি অত দুর্বল নয় যে, তাঁরা মন্ত্রী-সচিবদের কথা সহজে ভুলে যাবেন।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]