কোরবানির চামড়ার দামে ধস

‘খলের ছলের অভাব হয় না’—এই প্রবাদের সত্যতা কোরবানির চামড়া কেনাবেচার সময় ধরা পড়ে। কোনো না-কোনো একটি বাহানা সামনে এসে হাজির হয়। সেই বাহানা দেখিয়ে চামড়ার দর প্রতিবছর নামিয়ে ফেলা হয়। আড়তদার আর ট্যানারির মালিকদের অভিনব সব দুষ্ট যুক্তির মারপ্যাঁচে পড়ে গৃহস্থরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। দু-চার টাকার আশায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পথে বসে যান। 

কোনো বছর বলা হয়, বাজারে লবণের সংকট, লবণ না থাকায় চামড়া সংরক্ষণ করা যাবে না, তাই স্বাভাবিক দরে চামড়া কেনা যাবে না। কোনো বছর আন্তর্জাতিক বাজারের ধসের সূচক সামনে তুলে ধরা হয়। কোনো বছর হয়তো বলা হয়, সংরক্ষণাগার নেই। ফি বছর এই সব ‘তাইরে-নাইরে’ বলে মধ্যস্বত্বভোগীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সরকারের পক্ষ থেকে ফি বছরই ‘একটা কিছু’ বলে দায় এড়ানো হয়। তবে এবার যা হয়ে গেল তা নজিরবিহীন। 

এ বছর ‘স্বরচিত’ লবণসংকট নেই। গোডাউনেও জায়গা আছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও সমস্যা দেখা যায়নি। কিন্তু এবারের ঘটনা আগের চেয়ে খারাপ। স্বাভাবিক সময়ে যে চামড়ার দাম তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা, এবারের কোরবানি ঈদে সেই চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০-৪০০ টাকায় কিনেছেন। তাঁদের সেই চামড়া আড়তে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে ২০০–২৫০ টাকায়। চট্টগ্রামে ৩০০-৪০০ টাকা দিয়ে কেনা চামড়া ৫০, এমনকি ১০ টাকায়ও বিক্রি হয়নি। রাগে-দুঃখে সড়কের ওপর লক্ষাধিক চামড়া ফেলে গেছেন তাঁরা। সুনামগঞ্জে বিক্রি করতে না পেরে প্রায় ৯০০ চামড়া মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। 

অন্য বছরগুলোতে ট্যানারির মালিকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে একটা দাম বেঁধে দিতেন। তাঁদের এই একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করতে এ বছর কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়। এতে এখন আড়তদারেরা চাইলে ট্যানারিতে চামড়া না দিয়ে সরাসরি রপ্তানি করতে পারবেন। ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, আড়তদারেরা নিজেরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতে তাঁরাই লাভবান হবেন। আর আড়তদারদের অভিযোগ, ট্যানারির মালিকেরা গতবারের চামড়ার দাম পরিশোধ না করায় এবার বেশির ভাগ আড়তদার বা ব্যবসায়ী চামড়া কেনেননি। ফলে চামড়ার দাম কমে গেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চামড়ার দাম কমার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। প্রশ্ন হলো, তঁারা কীভাবে কারসাজি করতে পারলেন? এ বিষয়ে সরকারের কি অগ্রিম কোনো পরিকল্পনা ছিল? চামড়াশিল্প একটা বর্ধিষ্ণু রপ্তানি খাত, কোরবানির ঈদে বিপুল পরিমাণ চামড়া উৎপন্ন হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চামড়াশিল্পকে কথিত কারসাজি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো উচিত। আর কথিত কারসাজির হোতাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে শাস্তির পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যতে কোরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে এ ধরনের কারসাজির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে এর বিকল্প নেই।