ঈদের নিরানন্দ যাত্রা

এবারের ঈদযাত্রায় উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হলো। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে যমুনা সেতুর পশ্চিম পারে সবচেয়ে কাছের জেলা সিরাজগঞ্জে যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা এবং সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়ে লাগে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু এবার ঈদের যাত্রা শুরুর দিন ৮ আগস্ট থেকে সিরাজগঞ্জ যেতে লেগেছে ৭-৮ ঘণ্টা আর অনেকে দেড় দিনেও পঞ্চগড়ে পৌঁছাতে পারেনি। সে তুলনায় গত রোববার ১০ ঘণ্টায় বগুড়ার শেরপুর পৌঁছানো জলদিই বলা যায়। কারণ, শুক্র-শনিবার যারা রওনা দিয়েছিল, তাদের নাকি ১৮–২০ ঘণ্টা লেগেছে।

নিজের অভিজ্ঞতা হলো, মহাখালী টার্মিনাল থেকে আমার বাস ছিল রোববার (১১ আগস্ট) সকাল সাড়ে নয়টায়। টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল, ব্যাগ-বোঁচকাসহ গিজগিজ করছে অসংখ্য মানুষ। বাস কাউন্টারগুলোর সামনে জটলা, উত্তেজিত বাগ্‌বিতণ্ডা। বাস কোম্পানিগুলোর লোকেরা বলছেন, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাঁরা জানেন না। ঈদযাত্রার প্রথম দিন থেকেই শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। তখন ১০টার কাছাকাছি সময়। আমার গাড়ি যে পরিবহনের কাউন্টারে, তাদের লোকেরা বললেন, সকাল সাড়ে ছয়টার গাড়ি কিছুক্ষণ পর ছাড়বে।

বাসায় ফিরে যাব, না কী করব, ভাবতে পারছি না। ইতিউতি ঘুরছি। অন্য এক পরিবহনের কাউন্টারের সামনে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। তিনি এখানে টিকিট নিয়েছিলেন, আমারও একটা ব্যবস্থা হলো। ১০০০ টাকায় বগুড়ার একটি টিকিট পাওয়া গেল। এই পরিস্থিতিতে টাকাটা বড় নয়, টিকিট পাওয়াই বিরাট সৌভাগ্য। সেটা কীভাবে হলো, তা বলি। এই পরিবহনের সকাল ১০টায় যে গাড়ি ছাড়ার কথা ছিল, সেটি নাকি চান্দাইকোনা (সিরাজগঞ্জ) আটকে আছে। ঢাকায় কখন আসবে ঠিক নেই। কাউন্টারের লোকেরা একটি বাস ভাড়া নিয়ে ১০টার গাড়ির যাত্রীদের পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য যঁারা আগেই টিকিট কিনেছেন, তাঁরা এই বাসে যেতে চাইলে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। আর যাঁদের টিকিট নেই, তঁাদের ১০০০ টাকা। যেসব যাত্রীর টিকিট আগেই কেনা ছিল, তঁাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, চিৎকার করলেন, অবশেষে হাল ছেড়ে বাড়তি ৫০০ টাকা দিয়ে বাসে উঠলেন। বাসটা মোটামুটি ভালোই, ছাড়তেও বেশি গড়িমসি করল না। বেলা ১১টা নাগাদ রওনা হওয়া গেল।

ঢাকায় ছুটির নিরিবিলি। সাভার ও চন্দ্রা মোড়ে হালকা জটলা পেরিয়ে দ্রুত ছুটছে গাড়ি। একটু ঝিমুনি ধরে এসেছিল, তা ছুটল হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায়। চোখ মেলে দেখি সড়ক বিভাজকের এ পাশটায় বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ির তিনটি সারি। বিভাজকের অন্য পাশ ফাঁকা। বহুক্ষণ পরপর দু–একটি গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটে যায়। এ পাশে অসহ্য স্থবিরতা।

মির্জাপুর পেরিয়ে বাস থেমেছে। শোনা গেল জায়গাটি এলেঙ্গার কাছেই। প্রখর রোদে পুড়ে যাচ্ছে চারপাশ। অনেক মানুষ যাচ্ছিল পশুবাহী ফিরতি ট্রাকে। রোদে পুড়ে তঁাদের ভাজা ভাজা অবস্থা। কেউ কেউ মাথার ওপর গামছা বা কাপড় জড়িয়ে নিয়েছেন, কেউ নেমে এসে আশপাশের গাছের ডাল ভেঙে মাথার ওপর ছাতার মতো মেলে ধরেছেন। বাচ্চাদের অবস্থা নেতিয়ে পড়া ছিন্নমূল লতার মতো। চার লেনের কাজ চলছে। সারা রাস্তা ভরা আলগা ধুলা।

অনেকক্ষণ পরপর একটু করে বাস এগোয়, আবার আটকে যায়। পাশাপাশি তিন সারির গাড়িগুলোর মধ্যে সুযোগ পেলেই একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তাতে মাঝেমধ্যে আরও জটলা লেগে যায়। তখন আবার অনড় অবস্থা। খাবারের ব্যবসা জমে উঠেছে। পানি, শরবত, ড্রিংকস, কলা, রুটি, চিপস থেকে শুরু করে পলিথিনের প্যাকেটে খিচুড়ি পর্যন্ত নানা রকমের খাবার নিয়ে গাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করছিলেন বিক্রেতারা। পানিই বিক্রি হচ্ছিল বেশি।

এলেঙ্গা পেরিয়ে যমুনা সেতুর সংযোগ সড়কে ঢোকার মুখে দেখা গেল জটলার প্রধান উৎস সেখানেই। সংযোগ সড়কটি দুই লেনের, আর সেখানে তিন সারির অসংখ্য যানবাহন ঢোকার চেষ্টা করছে। কিছু যানবাহন ঢুকে গেছে উল্টো পাশে। ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা। দু–একজন পুলিশ ফুটপাতের পাশে নিরাপদ দূরত্ব রেখে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে বটে, তবে তাতে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না। এখানে লম্বা সময় কাটিয়ে যখন সেতুর কাছে আসা গেল, তখন বেলা গড়িয়ে বিকেল।

সবার মধ্যে একরকম হাঁপ ছেড়ে বাঁচার মতো স্বস্তি এল। কিন্তু সিরাজগঞ্জ মোড়ের কাছে আবার ফিরতি যানবাহনের মূল সড়ক থেকে সংযোগ সড়কে ওঠার জটলা। এদিকে চার লেনের কাজ শুরু হয়নি। এক পাশে খুব অল্প জায়গা। কোনোরকমে একটি গাড়ি যেতে পারে। অপর পাশে ফিরতি গাড়ির দুই সারি। সেই সারি ভূঁইয়াগাঁতি ছাড়িয়ে গেছে। আর সেতুর এ পাশেও ঠিক অপর পাশের মতোই খুব অল্প কয়েকজন পুলিশকে দেখা গেল, কার্যত যারা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকাই পালন করছিল। বগুড়ার ২০ কিলোমিটার আগে, শেরপুরে যখন নামলাম, তখন বেলা ডুবে অন্ধকার।

এবার উত্তরবঙ্গে ঈদযাত্রার শুরু থেকেই প্রচণ্ড যানজট হচ্ছিল। ঢিলেঢালা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণেই (বিশেষ করে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ এলাকায়) এত জনদুর্ভোগ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তৃপ্তি প্রকাশ করেছিলেন পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে এবার যানজট হয়নি। উত্তরাঞ্চলে তাঁর ভাষায় ছিল ‘যানজট নয় ধীরগতি’। কাজেই সাফাই সম্পন্ন হলো। তবে এ–ও সত্য, যাঁরা অশেষ দুর্ভোগ পোহালেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা এই সরকারি বক্তব্যের উল্টো।

প্রতিবছর দুই ঈদে এমন দুর্ভোগ যাত্রীদের অনিবার্য নিয়তি হয়ে উঠেছে। চড়া দামে বাসের আগাম টিকিট করেও তাঁরা ভোগান্তি থেকে রেহাই পান না। বরং নানা অজুহাতে দায় এড়িয়ে সমস্যাটিকে হালকা করার চেষ্টা চলে। মানুষের এত কষ্ট, অথচ কখনো শোনা যায়নি এর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে কাউকে সাজা দেওয়া দূরের কথা, নিদেনপক্ষে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হয়েছে। শুধু এই বিচ্যুতির কথাই–বা বলি কেন, অন্য কোনো ক্ষেত্রেও কখনো কি তা হয়েছে?

আশীষ-উর-রহমান প্রথম আলোর নগর সম্পাদক