আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি

আজ শরতের প্রথম দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:

তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে।

জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে॥

       শরৎ-আলোর আঁচল টুটে    কিসের ঝলক নেচে উঠে,

                   ঝড় এনেছ এলোচুলে॥

শরতের মতো একটা শুভ্র ঋতুর আগমনে কেন তিনি মরণ দেখতে পেয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। ১৯১৪ সালের আগস্টে এই গান লেখার সময় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগমনীসংকেত দেখে শিউরে উঠেছিলেন। 

আগস্ট নিষ্ঠুরতম মাস। শ্রাবণ মাসও আমাদের মহৎপ্রাণ মানুষদের বিদায়ের মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়েছিল ১৫ আগস্ট। ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলা হয় ৬ আর ৯ আগস্ট। আমরা ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতার কথাই–বা ভুলি কী করে! 

গতকাল ছিল ১৫ আগস্ট। আজ পয়লা ভাদ্র। আমরা বিবিসির জরিপে দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে নির্বাচিত করেছিলাম আগস্টে বিদায় নেওয়া জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন দিয়েছিলেন। বাঙালি যে একটা গৌরবদীপ্ত জাতি, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি যে অত্যন্ত ঋদ্ধ, এই গৌরববোধের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা ঋণী। সেই গৌরববোধ থেকেই ভাষা আন্দোলন; ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ স্লোগান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্নে আকুল হলো, ২৪ বছর সংগ্রাম করল এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ল সেই বাঙালি জাতীয়তাবোধ থেকেই।

আমরা যখন দেশের বাইরে যাই, তখন জাতীয় সংগীত শুনলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’—এই সুরে ঠোঁট মেলাতে গেলে আমাদের চোখ আপনা–আপনিই ভিজে আসে। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের সময় বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে একটা আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল গার্ডিয়ান–এ। তাতে পৃথিবীর জাতীয় সংগীতগুলো থেকে বাছাই করে একটা শীর্ষ দশের তালিকাও প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটিকে রাখা হয় দ্বিতীয়তে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত অপরূপ। এর কথার কোনো তুলনা নেই! এই গানে জাতিগৌরব, দেশগৌরব নেই, আছে ভালোবাসার কথা। আছে বাংলার সৌন্দর্যদৃশ্য ধ্বনির অপরূপরতার কাব্যিক বর্ণনা। পুরোটাই কবিত্বে ঋদ্ধ। ‘আমার সোনার বাংলা’ কথাটাই একটা রূপক। এর পেছনে আছে রূপকথা, আছে কিংবদন্তি, আছে বাংলার গৌরবময় ইতিহাস। ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে/ ওমা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’—এই কথাও কবিত্বময়। 

এই গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে। এর সুর তিনি নিয়েছিলেন শিলাইদহের বাউল গগন হরকরার কাছ থেকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুহম্মদ মন্‌সুর উদ্দিনের হারামণি গ্রন্থের ভূমিকায় বাউল গান শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন:

‌‘আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা–সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন্‌ এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল—

“কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে!

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।”’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাউল গান দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে পূর্ব বাংলার বাউল সুর মিলেমিশে ব্যাপারটিকে এক স্বতন্ত্র মাহাত্ম্য দিয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী। ১৯৫৬ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নেতারা। অনেকেই উর্দুভাষী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে তাঁদের সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সংগীত–নাটক–নৃত্য ভালোই হলো। কিন্তু শেখ মুজিব বলে বসলেন, ‘এত নাটক হলো, গান হলো, কিন্তু তোমরা “আমার সোনার বাংলা” শোনাবা না?’

শিল্পীরা আবার মঞ্চে উঠলেন। সবাই মিলে গান ধরলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিবকে বাংলার মানুষ মুক্ত করে এনেছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিশ্চিত ফাঁসির রজ্জু থেকে। তিনি এখন বঙ্গবন্ধু। শিল্পীরা তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। এঁদের মধ্যে তাঁরাও আছেন, যাঁরা ১৯৬৭ সালে রেডিও–টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। দালাল শিল্পী–বুদ্ধিজীবীদের সংবর্ধনায় যেতে বঙ্গবন্ধুকে মানা করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমিও যাব, আপনিও যাবেন।’ সংবর্ধনায় তাঁরাই রবীন্দ্রপ্রীতি দেখালেন, বঙ্গবন্ধুর স্তাবকতা করলেন, কিছুদিন আগেও যাঁরা বিবৃতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের সমালোচনা করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আপনাদের রবীন্দ্রপ্রীতিতে আমি মুগ্ধ হয়েছি, আপনারাই কিছুদিন আগে রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। যাক, আপনারা “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটা এবার গেয়ে শোনান।’ জাহিদুর রহিমকে খুঁজে–পেতে আনা হলো। সব শিল্পী মিলে গান ধরলেন—‘‌আমার সোনার বাংলা’।

১৯৭১ সাল। ৩ জানুয়ারি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা। বঙ্গবন্ধু সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের শপথ করালেন, কেউই ৬ দফা থেকে এক অক্ষরও সরবে না, সরতে পারবে না। সভার শেষে দুটো গান পরিবেশিত হয়। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ আর ‘আমার সোনার বাংলা’।

এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‌‘সেদিন রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে আমাদের উদ্দেশ করে বললেন, “দেশটা যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে গ্রহণ করো।”’

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের অমর চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়াতে গানটি চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা ইউটিউবে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ দেখি, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং ক্যাম্পে সমবেত কণ্ঠে গাইছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। 

বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ শব্দবন্ধটি তুলে নিয়েছিলেন এই গান থেকে। সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন তিনি দেখতেন, এই স্বপ্নে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন দেশবাসীকে। ১৯৭০–এর নির্বাচনের আগে পোস্টার করা হয়েছিল, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’। স্বাধীনতার পর তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’ 

বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। রাষ্ট্র দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের গৌরববোধ দিয়েছেন, দিয়েছেন জাতীয় সংগীতের বাণী। আজ পয়লা শরতে এই দুইজনকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। 

আমরা এত সুন্দর একটা গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে পেয়েছি, এ–ও তো আমাদের জন্য এক বিশাল গৌরব। আমরা প্রাণভরে গাই, ‌‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন/ ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি। সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক