ডেঙ্গু ঠেকানোর একটি উপায়

লাল বৃত্ত চিহ্নিত এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই এসব এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
লাল বৃত্ত চিহ্নিত এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই এসব এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।

মশা মারতে কামান দাগানো শুধু কথার কথা না। ডেঙ্গুর মতো ইয়েলো ফিভারও একটি মশাবাহিত রোগ। ১৮ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে যখন ইয়েলো ফিভার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন গবেষকেরা সূত্র খুঁজতে খুঁজতে একটা হোটেল আবিষ্কার করেন, যেই হোটেলের আশপাশে প্রথম ইয়েলো ফিভার ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই হোটেলটি ছিল যুদ্ধফেরত সেনাদের থাকার জায়গা। পরবর্তী সময়ে যাতে আর ইয়েলো ফিভার ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেই কারণে হোটেলটি কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্ভবত সেই থেকে মশা মারতে কামান দাগার প্রবচনের শুরু।

ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে এডিস মশার মাধ্যমে। অন্য মশা যেমন এনোফিলিস, কিউলেক্স ইত্যাদি প্রজাতির মশা কিন্তু ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে না। তাহলে এডিস মশা কি হঠাৎ করে গত ২-৩ মাসে জন্মানো শুরু করল? আসলে তা না। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেও ঢাকাতে এডিস মশা ছিল। কোনো একজন ব্যক্তি বা ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশা হয়তো বিমানে করে বাংলাদেশে আসার পর থেকে তার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। এর আগে অন্য এডিস মশাগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল না। তারা এখনকার মতোই মানুষকে কামড়াত, কিন্তু ডেঙ্গু ছড়াত না।

কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি স্ত্রী এডিস মশা কামড়ানোর পর সেই মশা ভাইরাসে সংক্রামিত হয়। এরপর সেই মশা যখন অন্য কাউকে কামড় দেয়, সেই ব্যক্তিও তখন সংক্রামিত হয়। এভাবে বিস্তার চলতে থাকে। এই কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি এডিস মশার কামড় থেকে দূরে রাখা যায়, তাহলেই কিন্তু একসময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রথমে যখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়া শুরু হলো, তখন আমি মোটেও আতঙ্কিত ছিলাম না। কারণ, সরকারের সংশ্লিষ্ট এতগুলো দপ্তর ও পাবলিক হেলথে দক্ষ এমন অনেক বড় বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করছে, তাদের প্রতি আমার আস্থা ছিল। কিন্তু দিন দিন অবস্থা গুরুতর হওয়া শুরু করল। এবং কার্যকর কোনো অ্যাকশন প্ল্যান দেখতে পেলাম না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোথা থেকে কাজ শুরু করতে হয়, সেই ধরনের কিছু পড়াশোনা আমার আছে। মাঝের কয়েক মাস ছাড়া গত ৮ বছরে ইউএসএআইডির বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং-ওয়ার্কশপ, যেমন জিআইএস, ডেমোগ্রাফিক অ্যানালাইসিস, ডেটা প্রেজেন্টেশান ইত্যাদি করার সুযোগ আমার হয়েছে। এই দুই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমার মনে হয়েছে, কিছু একটা করার দায়ভার আমার ওপরেও বর্তায়। কারণ, দেশটা আমারও। সেই তাড়না থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটা শুরু করি।

আমি গত ৪ আগস্ট দুপুরে ফেসবুকে একটা পাবলিক স্ট্যাটাস লিখি ‘কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি ডেঙ্গু আক্রান্তদের ঠিকানা জোগাড় করার কাজটা করতে পারে, বাকি কাজটা আমি ভলান্টিয়ার হিসেবে করে দিতে আগ্রহী।’

স্ট্যাটাসটি মেজার ইভাল্যুশনে কর্মরত আমার একজন পুরোনো কলিগ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দৃষ্টিগোচরে আনেন। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন। আমি আসলে কী করতে চাই, সেই বিষয়ে আলোচনার জন্য তাঁদের দপ্তরে আমাকে আমন্ত্রণ জানান। আমি ৪ তারিখ সন্ধ্যার পর তাঁদের অফিসে যাই। আমি একটা ম্যাপ করার পরিকল্পনার কথা জানাই, যাতে ঢাকার কোথায় কোথায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, ডেঙ্গু হওয়ার সূত্রগুলো কী—সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করা যায়। এবং সেই অনুযায়ী কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু ডেটা কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে, সেই আলোচনা ওই দিন সন্ধ্যায় চূড়ান্ত করা যায়নি। যেটুকু বুঝতে পারলাম, ডেঙ্গু রোগীর তথ্য, বিশেষত ঠিকানা পাওয়াটা খুব সহজ কাজ হবে না। যেহেতু হাতে সময় খুব কম, বাসায় ফেরার পথে ব্যাকআপ প্ল্যান হিসেবে একটা অনলাইন ফরম বানানোর কথা চিন্তা করলাম। যেখানে ক্রাউডসোর্সিং করে ডেটা সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। বাসায় ফিরে রাতেই অনলাইন তথ্য সংগ্রহ ফরমটা তৈরি করে ফেসবুকে শেয়ার করলাম। পরদিন কয়েকজন সেটা বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ভাইরাল করেন। ৫ তারিখ রাতে যেটুকু ডেটা পেয়েছি, সেগুলো দিয়ে প্রথম ম্যাপ তৈরি করলাম।

৯ আগস্ট রাত পর্যন্ত ৪ দিনে মোট ২৪৫ জন তথ্য দিয়েছেন। তার মধ্যে ২৫ জনের তথ্যে গরমিল বা যেটুকু ঠিকানা উল্লেখ করলে আমি স্থানটির কাছাকাছি পিন পয়েন্ট করতে পারি, তেমন ঠিকানা উল্লেখ করা ছিল না। যেমন ঠিকানার জায়গাতে কেউ কেউ শুধুমাত্র ধানমন্ডি/গুলশান/মিরপুর/উত্তরা—এমনটা লিখেছেন। এই ২৫ জনের ডেটা সেই জন্য পর্যালোচনার মধ্যে নেওয়া হয়নি।

লাল বৃত্ত চিহ্নিত এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই এসব এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
লাল বৃত্ত চিহ্নিত এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই এসব এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।

ক্রাউডসোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত সব থেকে ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা ছিল ধানমন্ডি থেকে গ্রিনরোড হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এলাকা। তারপর নিকেতন থেকে বাড্ডা পর্যন্ত এলাকা। এরপর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও উত্তরা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এর বাইরে কম-বেশি অনেক জায়গাতেই ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই ৪ জায়গাতে ওই ৭ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার সব থেকে বেশি।

এখন আমি মনে করি, লাল চিহ্নিত জায়গাগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এডিস মশা জন্ম নেওয়ার স্থানগুলো দ্রুত ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কাজটি করার জন্য সিটি করপোরেশন স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারে। তাতে কাজটি করতে তুলনামূলক সহজ হবে বলে আমার মনে হয়।

এ ছাড়া চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলব, যে স্থানগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে সেই স্থানগুলোর আশপাশে হাসপাতালের সংখ্যাও বেশি। আমি নিজে দুটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, হাসপাতালের সব ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং ডেঙ্গু ঠেকাতে শুধু বাসার টব, টায়ারের পানি ফেললে হবে না। সংক্রমণ বন্ধ করতে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখাটাও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের থেকেও মশাকে দূরে রাখার কাজটা নিশ্চিত করা দরকার।

ঈদের বন্ধে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে অনেকে দেশের বাড়িতে গেছেন। সেখানেও নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এলাকায় যাতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে—অবশ্যই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে মশার নাগালের বাইরে রাখা।

আমি মনে করি, ভবিষ্যতে যেকোনো আউটব্রেক ঠেকাতে এখন থেকেই একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত। যেখানে কেন্দ্রীয় একটা তদারকি ব্যবস্থা থাকবে। একটা দক্ষ তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা থাকবে। ডাইনামিক ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যার যার প্রয়োজনমতো গ্রাফ, ম্যাপ দেখতে পারবেন। এবং যার যেটা করণীয়, তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।

এই কাজ করার জন্য যাঁরা ফরম শেয়ার করাসহ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

লেখক: চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী এবং আইসিসিডিডিআরবির সাবেক সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর