আমার বন্ধু মীজানূর রহমান শেলী

মীজানূর রহমান শেলী
মীজানূর রহমান শেলী

মীজানূর রহমান শেলীর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৭ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। ওই সময়ে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম বেড়াতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের কামরায় আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে দীর্ঘ সময় লাগত। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম পাশে বসা ছেলেটি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে দারুণ আড্ডায় মেতে উঠেছে। প্রথম দিকে আমি চুপচাপ থাকলেও পাশের ছেলেটি আমাকে ওদের মধ্যে টেনে নিল। আমরা যে সবাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে একই স্থানে বেড়াতে যাচ্ছি, সেটাও জানা হয়ে গেল। আরও জানা হয়ে গেল, ওর নাম মীজানূর রহমান শেলী, সেন্ট প্রেগরিজ স্কুলের ছাত্র। আমি যে নবাবপুর হাইস্কুলের ছাত্র, সেটা তাদের জানিয়ে দিলাম। সদ্য স্কুলের চৌকাঠ পেরোলেও আমরা তখন রীতিমতো লেখক, অর্থাৎ আমাদের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়। 

ম্যাট্রিকের রেজাল্ট ওর খুব ভালো হয়নি। সে দেশের মধ্যে ২০তম হয়েছিল। তবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় সবগুলো বোর্ডের মধ্যে মেধাতালিকায় হয়েছিল প্রথম। তখন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড একত্রীভূত ছিল। সারা দেশের মধ্যে প্রথম হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। তা ছাড়া, অনার্স ও এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল শেলী। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) শেলী তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় হয়েছিল। 

কলেজজীবনে আমার সঙ্গে শেলীর যোগাযোগ ঘনীভূত হয়। আমরা উভয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। লেখালেখির সূত্র ধরে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিবিড় হয়েছিল। উপন্যাস পাতালে শর্বরী, অলীক আত্মীয়, গল্পগ্রন্থ ফেরারি প্রহর ছাড়াও অনেক গবেষণামূলক গ্রন্থের রচয়িতা সে। অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালনের মধ্যেও শেলীর লেখালেখির কলম কখনো থেমে যায়নি। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তার ইংরেজি ও বাংলায় লেখা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। 

বিশ্ববিদ্যালয়–জীবন শেলী ও আমার বন্ধুত্বের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এর বহু কারণ আছে। ষাটের দশকের প্রারম্ভে আমি দৈনিক ইত্তেফাক–এর বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার নিযুক্ত হই। তখন অন্য কোনো পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ছিল না। কয়েক মাস পর শেলী তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে নিযুক্তি পায়। ষাটের দশকের প্রারম্ভে তুমুল ছাত্র আন্দোলনের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারদ্বয়ের খুবই কদর ছিল। ওই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যঁারা জড়িত ছিলেন, তাঁরা সবাই আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। 

আমার ও শেলীর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন অনেকটা পারিবারিক সম্পর্কে স্থাপিত আরেকটি বিশেষ কারণে। আমাদের দুজনের স্ত্রীরা ছিলেন আমাদের সহপাঠী। শেলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় সালমাকে বিয়ে করেছিল। আর আমি নীলুফারকে বিয়ে করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোবার কয়েক মাস পরে। সালমা ও নীলুফার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। পারিবারিকভাবে তাঁদের উভয়েরই যোগাযোগ ও আসা-যাওয়া ছিল। জীবনের শেষ দিনগুলোতে সালমা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রবল অসুস্থতার মধ্যেও সালমা হুইলচেয়ারে করে আমার ও নীলুফারের বিয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমরা চিরকাল সালমার কাছে কৃতজ্ঞ। 

শেলীর সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে ১৯৭৭ সালে লন্ডনে ও জ্যামাইকার কিংস্টনে। সে বছর জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কমনওয়েলথ যুব সম্মেলন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো থেকে যুবনেতারা ওই সম্মেলনে যোগ দিতে কিংস্টনে সমবেত হয়েছিলেন। অনেকেই তাঁদের দেশের মন্ত্রী বা এমপি। এদের সবার বয়স ৩৫ বছরের নিচে। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি আমি ও শেলী। শেলী তখন সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক ও আমি সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিভাগের উপসচিব। দুই সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদলে শেলী দলনেতা ছিল। 

আমাদের সম্মেলন কিংস্টনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সাত দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতিটি সেশনে শেলী অসাধারণ বক্তব্য রেখেছে। ওর শব্দচয়ন, কথনভঙ্গি ও রসজ্ঞান তুলনাহীন। শেলী বক্তৃতায় কমনওয়েলথ যুব প্রতিনিধিদের সর্বদা মাতিয়ে রেখেছিল। ফলে সম্মেলনের কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন দেশের যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা আমাদের সার্থক হয়েছিল। 

পূর্বে উল্লেখ করেছি শেলীর সঙ্গে লন্ডনেও আমার সুন্দর সময় কটেছে। জ্যামাইকা আসার পথে লন্ডনে আমরা দিন কয়েক যাত্রাবিরতি করি। বলতে গেলে সেটা ছিল আমার প্রথম বিদেশভ্রমণ। আজও মনে আছে ১৯৭৭ সালের ২ মে আমাদের বিমান যখন হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করছিল, তখন আমি ভোরের আলোয় লন্ডন শহরকে প্রথম দেখার রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। এরপর বেশ কয়েকবার লন্ডনে গেলেও প্রথম দেখার স্মৃতি ভুলতে পারিনি। যে দুই দিন সেখানে ছিলাম, শেলীর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি। লন্ডন শহর প্রথম দেখার জন্য শেলী ছিল চমৎকার একজন গাইড। কারণ, শেলী তার আগেও লন্ডনে বেড়াতে এসেছিল। 

ওর বড় গুণ ছিল ওর সাহায্য ও সহযোগিতার হাত সব সময় প্রসারিত থাকত। বন্ধুরা কেউ অসুবিধায় পড়লে শেলী সর্বাগ্রে এগিয়ে আসত। জীবনের শেষ সময়ে শেলী পারিবারিকভাবে নানাবিধ সমস্যায় পড়েছিল। এর প্রধান কারণ পরপর ওর ছোট চার ভাইয়ের মৃত্যু। এ ছাড়া, ওর সবচেয়ে বড় বোন ও ছোট বোনও মারা গিয়েছিলেন। ফলে বৃহত্তর পরিবারটিকে শেলীর নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। এর মধ্যে শেলী নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকবার তাকে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতে হয়। ওর ছোট ভাই টিপু মাঝেমধ্যেই টেলিফোনে জানাত যে, ‘শেলী ভাই অমুক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।’ খবর পেয়ে সেসব হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছি। কখনো শয্যাপাশে বসে গল্প করেছি, কখনোবা ওর মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে দাঁড়িয়ে দোয়া করা ছাড়া আর কিছু করণীয় ছিল না। শেষের দিকে সপ্তাহে দুই দিন তার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক ব্যাধি ছিল মস্তিষ্কে। ওর মস্তিষ্কের অংশবিশেষ অবশ হয়ে গিয়েছিল এবং তা ছিল যেকোনো চিকিৎসার অতীত, যাকে দুরারোগ্য না বলে অনারোগ্য বলা সমীচীন। 

মীজানূর রহমান শেলী এখন না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। এখন সে সবার কাছে বেদনাবিধুর স্মৃতি। তবে সব স্মৃতিই যে বেদনায় নীল তা নয়, কিছু স্মৃতি আছে বহুবর্ণ, নানা রঙে বোনা। শেলীর স্মৃতির ছবি আমার কাছে সতত রঙিন। 

বন্ধু শেলী, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ জানি না। যেখানেই থাকো, পরম করুণাময় আল্লাহ যেন তোমাকে তঁার করুণাধারায় সিক্ত করে রাখেন, তাঁর অপার রহমতের চাদরে জাড়িয়ে রাখেন তোমাকে। 


মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার