শশী থারুরের ভবিষ্যদ্বাণী

ঝাড়খন্ডে গণনির্যাতনের (লিঞ্চিং) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ঝাড়খন্ডে গণনির্যাতনের (লিঞ্চিং) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এক বছর আগে ভারতের কংগ্রেস নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শশী থারুর কেরালার এক জনসভায় মন্তব্য করেছিলেন, নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারত হবে এক ‘হিন্দু পাকিস্তান’। সেই কথার জন্য চলতি সপ্তাহে কলকাতার এক আদালত থেকে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অভিযোগ, তাঁর এই বক্তব্য ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে। আগাম জামিনের ব্যবস্থা ছিল বলে কংগ্রেসের এই বিখ্যাত বিধায়ককে জেলে ঢুকতে হয়নি।

‘হিন্দু পাকিস্তান’ বলতে শশী থারুর কী বুঝিয়েছেন, তার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য: মুসলিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিদিন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ভারতে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে ঠিক সেই কাণ্ডই ঘটবে। ভারত হবে পাকিস্তানের মতো এক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, শুধু তফাত হবে মুসলিমের জায়গায় হিন্দু। তারা ভারতীয় শাসনতন্ত্র ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার করবে, নতুন করে তাদের পছন্দমতো হিন্দু ভারতের শাসনতন্ত্র লিখবে।

শশী থারুরের এই ভবিষ্যদ্বাণী যে একেবারে ভিত্তিহীন নয়, তার প্রমাণ এখন প্রতিদিনই মিলছে। যেমন ঝাড়খন্ডে এক মুসলিম যুবক ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে বিজেপি–সমর্থকদের হাতে জান খোয়াতে হয়েছে। এর আগে একই কারণে আরও তিন যুবক গণনির্যাতনের (লিঞ্চিং) শিকার হয়েছেন। একই রাজ্যে বিজেপির এক মন্ত্রীর বিরোধী কংগ্রেসের এক বিধায়ককে জোর করে জয় শ্রীরাম বলার চেষ্টা প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে যায়। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন জয় শ্রীরাম বলবেন না, তা নিয়েও হাতাহাতি হয়েছে। সরকারিভাবেই জানানো হয়েছে, সারা ভারতে এই স্লোগান নিয়ে কয়েক শ গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে ভারতের সেরা ৪৯ জন লেখক-বুদ্ধিজীবী এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন। তাঁরা চলতি অবস্থাকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বলে বর্ণনা করেছেন। 

ওপরের ঘটনাগুলো ঘটেছে মোদির দ্বিতীয় বিজয়ের পর। তাঁর প্রথম শাসনামল থেকেই গরুর মাংস খাওয়া ও বিক্রি নিয়ে গণনির্যাতন ঘটেছে। জোর করে ধর্মান্তরের ঘটনাও ঘটেছে।

নরেন্দ্র মোদি আবার ক্ষমতায় এলে হিন্দুত্বের জয়জয়কার হবে, এ কথা জানা ছিল, কিন্তু তাই বলে মানুষজন সব বিচারবুদ্ধি হারিয়ে বসবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। অবস্থা কতটা বিপজ্জনক (ও হাস্যকর), এ বছরের গোড়ার দিকে দিল্লিতে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনের খবর পড়লেই তা বোঝা যায়। সংক্ষেপে বলছি।

ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস নামে আয়োজিত ওই সম্মেলনে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বলেন, প্রাচীন ভারতে কয়েক হাজার বছর আগে স্টেম সেল নিয়ে শুধু গবেষণাই হয়নি, এর ব্যবহারও ব্যাপক ছিল। প্রমাণ? কেন, মহাভারতে তো কৌরব বংশীয় এক মায়ের এক শ সন্তান প্রসবের কথা বলা আছে। স্টেম সেলের ফলেই নাকি এটা সম্ভব হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কা অভিযানের সময় শ্রীরাম যে সেনাবাহিনী নিয়ে যান, তাদের কম করে হলেও দুই ডজন বিমান ছিল, সেখানে বিমানক্ষেত্রও ছিল। অজৈব রসায়নের এই নামজাদা অধ্যাপক নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেন, তারও আগে, সেই বৈদিক যুগে, বিষ্ণু যেকোনো চলন্ত লক্ষ্যবস্তুতে অবলীলায় আঘাত হানতে পারতেন, কারণ তাঁর কাছে ‘গাইডেড মিসাইল’ ছিল।

ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের আর কী দোষ! তিনি রাস্তাটা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজির কাছ থেকে। প্রথমবার দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর একই রকম আরেক বিজ্ঞান সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। প্রমাণ? মহাভারতেই তো গণেশের উদাহরণ আছে, তাঁর যে নাকের ওপর বিশাল হাতির শুঁড়, তা তো প্লাস্টিক সার্জারির ফলেই সম্ভব হয়েছিল। মহাভারতে কর্ণের কথা আছে, তিনি মায়ের গর্ভ থেকে প্রসবিত হননি। তা সম্ভব হয়েছিল সে সময়ে ভারতে ‘জেনেটিক সায়েন্স’ খুবই অগ্রসর ছিল বলে। এটাও মোদিজির আবিষ্কার।

সুস্থ মস্তিষ্কের ভারতীয় বিজ্ঞানীরা অবশ্য এই সব রূপকথার সঙ্গে একমত নন। কিন্তু তাতে কী, ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে এই সব গল্পগাথাকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে স্কুলপাঠ্য বইপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মোদির বিগত মন্ত্রিসভায় উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন সত্যপাল সিং। তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, পুরোনো ধ্যানধারণা বদলে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে। ওহ্ হ্যাঁ, এই ভদ্রলোকই গত বছর বলেছিলেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ মিথ্যা। বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী হর্ষবর্ধন আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, আইনস্টাইনের অনেক আগেই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন।

এমন অগ্রসর যে ভারত, সেখানে শৌচাগার কেন নেই, এ কথা অবশ্য এসব বিজ্ঞানী খোলাসা করে বলেননি।

ভারত তার সৃষ্টির প্রথম ছয় দশক নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণে ব্যয় করেছে। নেহরু-মাওলানা আজাদদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার জায়গায় এসেছেন হিন্দুত্ববাদী মোদি, তিনি চান প্রত্যেক ভারতীয় নিজেকে শুধু হিন্দু হিসেবে ভাবুক এবং সে জন্য প্রকৃত গর্ববোধ করুক। হিন্দু ভারতকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দাঁড় করানোর এই প্রচেষ্টা ঠিক অপরিকল্পিত বা আকস্মিক নয়। ভারতকে হিন্দু ভারতে পরিণত করা এবং সে জন্য সব হিন্দুর মনে প্রকৃত গর্ববোধ সৃষ্টি বিজেপির একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘প্রজেক্ট’। তিন দশক ধরে তারা এই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য দরকার ভারতকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা। শুধু আধুনিক ভারতের উদাহরণে সে কাজ করা যাবে না, তাহলে মুসলিমদের কথাও বলতে হয়। অতএব পেছনে যাও, একদম আদিতে চলে যাও। 

লোকসভা নির্বাচনের ফল থেকে স্পষ্ট, ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা পিছু হটছেন। বিপদ টের পেয়ে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দুজনেই শেষ মুহূর্তে হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। রাহুল গলায় গাঁদা ফুলের মালা ও গেরুয়া পরেছেন, প্রিয়াঙ্কা গঙ্গাযাত্রায় নেমেছেন। কাজ হয়নি, হিন্দুত্বের স্রোতে তাঁরা ভেসে গেছেন।

এই হিন্দুত্ব নিয়ে এখন এতই মাতামাতি যে মুম্বাই ও দিল্লির বাজারে গরুর মূত্র বোতলে বিক্রি হচ্ছে। শাস্ত্রে আছে গোমূত্র অমৃত, অতএব সবাই তা লাইন দিয়ে কিনছে। এমনকি গরুর গোবর থেকে প্রসাধনসামগ্রী তৈরি হচ্ছে, গোমূত্র থেকে লিপবাম। আধুনিক হিন্দু নারীরা ভক্তিভরে সেই গোবিষ্ঠা সানন্দে মুখে মেখে ও লিপবাম ঠোঁটে জড়িয়ে পার্টিতে যাচ্ছেন। (আমেরিকার পাবলিক রেডিওর এই রিপোর্টটি পড়ে দেখুন: https://bit.ly/33xBpbS) 

দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিকভাবে ভূমিধস বিজয়ের পর নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর বিজেপির পরবর্তী প্রকল্প ভারতকে শুধু হিন্দুদের একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাঁদের মতে, ভারতীয় কথার মানেই হলো হিন্দুত্ব। এই ভারতে মুসলিমরা থাকবে, অন্যান্য ধর্মের মানুষেরাও থাকবে, কিন্তু তাদের মানতে হবে, রাম তাদেরও প্রভু। ইতিমধ্যে বিজেপির বিজ্ঞানীরা দাবি করা শুরু করেছেন, হিন্দুরা ভারতের আদি মানব। অন্য কোনো স্থান থেকে নয়, এই ভারতেই তাদের উদ্ভব। যেহেতু হিন্দুরা আদি মানব, অতএব এই দেশের সবাই একসময় হিন্দু ছিল। এখন যারা নিজেদের মুসলিম বা অন্য ধর্মের অনুসারী বলে ভাবে, তাদের আবির্ভাব ঘটেছে অনেক পরে, বিদেশি আক্রমণের ফলে ধর্মান্তরের মাধ্যমে। এই সব সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ যদি আদিতে হিন্দু হয়ে থাকে, তাহলে রামকে ভগবান মানতে আপত্তি কোথায়? সেই কারণেই জয় শ্রীরাম স্লোগান। সুব্রামানিয়াম স্বামীর মতো বুদ্ধিজীবীরা এমন দাবিও তুলেছেন, মুসলিমরা যদি ভোট দেওয়ার অধিকার চায় তো সবার আগে তাদের মানতে হবে রক্তের সূত্রে তারাও হিন্দু। 

বিজেপির এই ‘প্রজেক্ট’ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করতেই শশী থারুর ‘হিন্দু ভারতের’ কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে। যারা মুসলিম নয়, সে দেশে তাদের অধিকার খর্বিত, খণ্ডিত। ভারত তার জন্মের গোড়া থেকেই এই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছিল। মহাত্মা গান্ধী একসময় নিজেকে একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-জৈন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। শশী থারুরের ভয়, বিজেপির বর্তমান নেতৃত্ব গান্ধী-নেহরুর এই বহুধর্মভিত্তিক ভারতকে বদলে ফেলে তাকে শুধু হিন্দুদের রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। বিজেপি যে হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলে, তা পাকিস্তানের মুসলিম রাষ্ট্রের অভিন্ন প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়কেরা—গান্ধী, নেহরু, সর্দার প্যাটেল, মাওলানা আজাদ—তাঁরা কেউই এই হিন্দু পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেননি।’

এই প্রকল্পের পরবর্তী ধাপ হলো কাশ্মীরের রাজনৈতিক চরিত্র বদল। এই প্রকল্পে যদি বিজেপির জয় হয়, তাহলে সেটি হবে ‘হিন্দু ভারতের’ আরেক বিজয়। 


১৪ আগস্ট ২০১৯, নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি