সড়কে মৃত্যুযাত্রা

এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার ধরন থেকে এ কথা বলা অমূলক হবে না যে চালকেরা আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ সড়ক যাত্রা এখন অনেকের কাছেই মৃত্যুযাত্রার শামিল। ময়মনসিংহের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রফিকুজ্জামান সপরিবার এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। তাঁদের বহনকারী গাড়িটি বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির বাসটিকে জায়গা করে দিতে গিয়ে খাদে পড়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় ওই পরিবারের চারজনসহ মোট পাঁচজন মারা যান। কক্সবাজারে পিকনিক থেকে ফিরে আসার পথে বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে বাসটি রাস্তার পাশে ধাক্কা দেয় এবং আটজন নিহত হয়। ফলে আনন্দের যাত্রা বিষাদে পরিণত হয়। এভাবে চালকদের বেপরোয়া যান চালানো, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ও জনসচেতনতার কারণে প্রতিদিনই বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের ছুটিতে ১২ দিনে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ নিহত ও ৮৬৬ জন আহত হয়। 

নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা গত বছরের আগস্টে আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন পাস করে, যাতে দুর্ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এর আগে জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল ১. চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, ২. দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করতে হবে, ৩. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করতে হবে, ৪. চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার রাখতে হবে এবং ৫. অবশ্যই সিগন্যাল মেনে চলতে হবে। 

এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর ৪ সেপ্টেম্বর সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি যে ৯টি সিদ্ধান্ত ও ২০ দফা সুপারিশ করেছিল, এর মধ্যে আছে আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেকে নামিয়ে আনা। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। আইন অমান্যকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গত বছর পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনও অকার্যকর হয়ে আছে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে। 

বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে সরকার নড়েচড়ে বসে। সড়ক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে কিছু সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকে। কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে চিঠিপত্র চালাচালিও হয়। কিন্তু তারপর সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। ঈদের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে যেটুকু নজরদারি ছিল, ফিরতি যাত্রায় তা-ও অনুপস্থিত ছিল। ফলে দুর্ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এভাবে কোনো দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থা চলতে পারে না।

সব দেশেই কমবেশি সড় দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা হলো অন্য অপরাধীরা শাস্তি পায়। আমাদের এখানে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থেকে যায়। গত শুক্রবার রাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের দুই নাগরিক মারা গেছেন, তার জন্য বেপরোয়া চালককে গ্রেপ্তার করেছে সেখানকার পুলিশ। 

কিন্তু ঈদের আগের ও পরে সড়ক দুর্ঘটনায় যে এতগুলো মানুষ মারা গেল, তার দায়ে পুলিশ কয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে? কোন সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় এনেছে?