ওরা কি আমাদের কেউ নয়

শিলা। মিলা। নিতাই। মাসুম। নামগুলো পিতৃপ্রদত্ত কি না, জানা যায়নি। হয়তো নামগুলো ওরা নিজেরাই দিয়েছে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভয়ারণ্যে পাখপাখালির মতো ওরাও এখানে আশ্রয় করে নিয়েছে। বেড়ে উঠছে আরিচা রোড, ‘প্রান্তিক’ যাত্রীছাউনিতে। 

ওরা ১১ জন। হয়তোবা আরও বেশি। জীবনের কোন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে এসে একসঙ্গে হয়েছে, কেউ জানে না। এক পরিবার নয়, কিন্তু কী এক অদ্ভুত রহস্যের টানে ওরা একসঙ্গে থাকে। হাসে। খেলে। জীবন কাটায়। 

কারও বয়স সাত কি আট। কারও তেরো কি চৌদ্দ। যেন ওরা একেকটি ফুল। যেন একগুচ্ছ ফুল ফুটে আছে প্রকৃতির নিদর্শন হয়ে। হাজার চোখের সামনে থেকেও যেন রয়েছে চোখের আড়ালে। আমরা দেখেও দেখছি না। গুরুত্ব দিচ্ছি না। 

বাস এসে যখন থামে, ওরা যে যার মতো চুপটি করে উঠে পড়ে একেকটি বাসে। শুভযাত্রা, তিতাস, অগ্রদূত, মৌমিতা, সাভার পরিবহন—এই বাসগুলোই ওদের প্রথম টার্গেট। অভিনব অভিনয় করে হাত পাতে যাত্রীদের সামনে। কাতর ভঙ্গিতে দু–একটি সত্য বা মিথ্যা বলতে পারে। দুটো পয়সা পায়। কিছু খেতে পারে। বাসে বাসে ছোটাছুটি করেই কাটে দিন। সপ্তাহ। মাস। বছর। 

পাঁচ বা দশ টাকা, যে যা দেয় তাতেই ওদের রোজকার উপার্জন উঠে আসে। এই টাকাতেই ওরা এটা-ওটা কিনে খায়। কখনোই খাওয়ার কোনো বাসনা অপূর্ণ রাখে না। হাতে টাকা আসামাত্র টুপ করে চলে যায় প্রান্তিকের খাবার দোকানে। নানরুটি, বার্গার, পিৎজা, চিপস, কোমল পানীয়, আইসক্রিম—এই সব খায়। ইচ্ছে হলে শখের দু–একটা জিনিসও কিনতে পারে। তারপর গাছতলা কিংবা ছাউনির দেয়ালের পাশে শুয়ে ঘুমায়। 

দিনের কোলাহল শেষে যখন রাত আসে, এই যাত্রীছাউনিতেই জড়ো হয় সবাই। সারা দিনে কার কত উপার্জন হয়েছে, হিসাব মিলিয়ে দেখে। না, কারও কোনো টার্গেট থাকে না যে এত টাকা উপার্জন করতে হবে। ওদের কোনো বস নেই যে উপার্জনের ওপর ছড়ি ঘোরাবে। যে যা পায়, তা নিয়েই থাকে সন্তুষ্ট। 

একটি দিন কেটে যাওয়ার পর পরের দিনটি কেমন যাবে, এই ভাবনাতেই চোখে নেমে আসে ঘুম। আকাশে হয়তো তখন জ্বলে চাঁদ কিংবা হাজার তারা। 

কারও মনেই সঞ্চয়ের ইচ্ছা নেই। কেন থাকবে? কার জন্য সঞ্চয় করবে? না আছে মা, না আছে বাবা, না আছে ভাইবোন। ফলে নেই কোনো ভবিষ্যতের চিন্তা। 

তারপরও ঘুমাতে যাওয়ার আগে চোখের সামনে হয়তো ভেসে ওঠে অস্পষ্ট মায়ের মুখটি। রোগা-পটকা আর অসহায় সেই মুখটি মনে হতেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে। স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মায়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমটা হয়ে ওঠে গভীর। কোনো কোনো দিন মা হয়তো স্বপ্নে এসে কপালে টিপ দিয়ে যায়। মায়ের ওইটুকু স্পর্শেই তীব্র শীত কিংবা ঝড়ের রাতেও ওরা থেকে যায় নিরাপদ। হয়তোবা কারও কারও চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো দিন না-দেখা বাবার মুখটিও। 

এই বয়সে পাখির ছানার মতো মায়ের আঁচলের তলে থাকার কথা ছিল। কথা ছিল বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা ছিল। কিন্তু না, প্রতারক নিয়তি ওদের ফেলে রেখে গেছে এই জনশূন্য যাত্রীছাউনিতে। 

যাত্রীছাউনির পুব পাশে জাতীয় প্রাণী গবেষণাকেন্দ্র। পশ্চিমে উচ্চপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দুই পাশের সবাই আছে যে যার কাজকর্ম, গবেষণা আর বৈষয়িক জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কারও সময় নেই এই নাম-পরিচয়হীন মানবশিশুদের নিয়ে চিন্তা করার। ওরা কোথায় গোসল করে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যায় কোথায়। প্রবল বর্ষণ কিংবা কালবৈশাখীর রাতে পথের পাশে গাছতলায় কিংবা যাত্রীছাউনিতে ওরা কীভাবে ঘুমায়। ঘুমাতে কি পারে? 

কিন্তু মা-বাবার আদর-স্পর্শ থেকে বঞ্চিত এই শিশুদের কোমল হাতগুলো হয়ে উঠতে পারে অপরাধীর হাত। তারা জড়িয়ে পড়তে পারে চুরি-ছিনতাই, মাদকাসক্তি, মাদকদ্রব্যের কেনাবেচা, খুন–ধর্ষণসহ নানা অপরাধে। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাস্তার যাত্রীছাউনিতেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এ রকম শত শত মানবসন্তান। আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র কি তাদের নিয়ে চিন্তা করে? তারাও যে এই সমাজেরই সন্তান, এই রাষ্ট্রের সদস্য এবং একদিন পূর্ণবয়স্ক নাগরিক হবে—এই ভাবনা কি আমাদের আছে? তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কি কোনো কর্তব্য নেই? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিসি ক্যামেরায় তাদের দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি তাদের দেখে? 

চলতি পথে হঠাৎ যাত্রীছাউনিতে ওদের জড়ো হয়ে হাসি-তামাশা করতে দেখে আমরা অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাই। হয়তো একমুহূর্ত ওদের নিয়ে ভাবি। কিন্তু এ পর্যন্তই। এই পথশিশুদের দেখভাল করার, অন্য কথায় তাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ কি ভাবে? 

ওরা কি আমাদের এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের কেউ নয়? এই পৃথিবীর কেউ নয়? ওরা কি ভিনগ্রহ থেকে এসেছে? এলিয়েন? 


মহিউদ্দীন আহমেদ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী