কাশ্মীর এখনো মনের ঝাঁপি খোলেনি

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

একটা তুলনা টানছি। কাশ্মীর উপত্যকার হিজবুল মুজাহিদ্দিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি ২০১৬ সালের জুলাই মাসে গুলিতে মারা যাওয়ার প্রথম ১০ দিনে শুধু দক্ষিণ কাশ্মীরে আড়াই শতাধিক পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল; তাতে ১ হাজার ৩৫০ জন নিরাপত্তারক্ষী আহত হয়েছিলেন, ১৮৫টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ৪২ জন কাশ্মীরি জনতা গুলিতে নিহত হয়েছিল। বন্দুকের পেলেটে আহত অগুনতি। 

এবার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর প্রথম ১০ দিনের হিসাব হলো, পাথর ছোড়ার মোট ঘটনা ১৬৬টি, ৪৫ জন নিরাপত্তারক্ষী কমবেশি আহত, তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের সংখ্যা ১৮, নিহত মাত্র একজন। বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এই তথ্যের সূত্র কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনী হলেও রাজ্য প্রশাসন সরকারিভাবে এই তথ্য স্বীকার করছে না। রাজ্যের মুখ্য সচিব বি ভি আর সুব্রামানিয়ামের দাবি, একজনেরও মৃত্যু হয়নি। একটাও গুলি চলেনি। ঘটেনি তেমন কোনো বিক্ষোভের ঘটনাও। তাঁর দাবি, উপত্যকায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। 

ঘটনা ও তা স্বীকারের মধ্যে এই ফারাকই আসল সত্য। বুরহানি হত্যা ও ৩৭০ ধারার বিলোপের পর কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া একধরনের হয়নি। কারণ, আগে কখনো এত দিন ধরে এভাবে সারা কাশ্মীর অবরুদ্ধ রাখা হয়নি। খবরের স্বচ্ছন্দ চলাফেরা এবং খবরের কাগজ প্রকাশের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞাও আগে আরোপ করা হয়নি। 

কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া যে ২০১৬ সালের মতো তীব্র হলো না, তার প্রধান কারণ অভূতপূর্ব অবরোধ হলেও অন্য কারণটি সম্ভবত কৌশলগত। সেই কৌশল ভবিষ্যতে কোন রূপ ও আকার ধারণ করবে, তা এখনো অজানা। তবে কাশ্মীরের নবতম রাজনৈতিক নেতা শাহ ফয়সাল, যিনি প্রথম কাশ্মীরি হিসেবে আইএএস পরীক্ষায় সারা দেশে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন, এখন যাঁর বয়স মাত্র ৩৫, বৈভব, আরাম ও নিশ্চিন্তির আমলাশাহির চাকরি ছেড়ে যিনি রাজনৈতিক দল গড়ে অনিশ্চিত জীবনে পা রেখেছেন, বিদেশযাত্রার ঠিক আগে যাঁকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে শ্রীনগরে নিয়ে গিয়ে বন্দী রাখা হয়েছে, ওই কৌশলের কথা তিনিই প্রথম শোনান। রাজ্যবাসীর উদ্দেশে তাঁর আবেদন, হিংসায় লাভ হবে না, বরং গান্ধীজির শেখানো অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পথে নামতে হবে। আরও কিছুকাল পর, নিষেধাজ্ঞা আরও শিথিল হলে ও রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পেলে বোঝা যাবে কাশ্মীর উপত্যকা প্রথামাফিক রাজনীতিতে আটকে থাকবে, নাকি অন্যভাবে জোটবদ্ধ হবে। 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যা করেছেন, আরএসএসের তা ঘোষিত নীতি। নীতি ঠিক না ভুল, সেই প্রশ্ন অবান্তর। যা তাঁর সরকার করল এবং যেভাবে করল, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে দেশে ও বিদেশে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ‘অসাংবিধানিক’ উপায়ে বাতিল করা যায় কি না, এটাই মূল প্রশ্ন। সরকারি ব্যাখ্যায় যা সাংবিধানিক, বিরোধী ব্যাখ্যায় তা অসাংবিধানিক। একমাত্র ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই বিতর্কের চূড়ান্ত মীমাংসার ক্ষেত্র। তা কত দিনে জানা যাবে, তা অস্পষ্ট। কিন্তু এটা স্পষ্ট, এই সিদ্ধান্ত বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীদের একীকরণে অনুঘটকের কাজ করেছে। সারা দেশের জন্য ‘এক বিধান (সংবিধান), এক নিশান (পতাকা) ও এক প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) ’— আরএসএসের এই সংকল্প সার্থক করার সাহস হিন্দুত্ববাদীদের পালে বাড়তি হাওয়া জুগিয়েছে। 

হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার এই বিকাশ অন্য বহু প্রশ্ন আমলেই আনছে না। যেমন কাশ্মীর যদি মুসলমানপ্রধান রাজ্য না হতো, তাহলে কি মোদি-শাহ জুটি এই সিদ্ধান্ত নিতেন? এই সরকার তো নাগাদের সঙ্গে স্বশাসন নিয়ে কথা বলছে। বিশেষ ধারা তো হিমাচল প্রদেশে আছে, উত্তরাখন্ডে আছে, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড় মায় গুজরাটেও আছে? আছে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। তাহলে কেন শুধু কাশ্মীরে কোপ? 

এসব প্রশ্নে আমল না দেওয়ার কারণ একাধিক। প্রথম কারণ, গোটা দেশে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদের হতশ্রী হাল। কংগ্রেস শয্যাশায়ী। অন্য ছোট ছোট দল কেউ বিজেপির বহুমুখী চাপে মাথা নুইয়েছে, কেউ সমঝোতা করে টিকে থাকা শ্রেয় মনে করছে। ফলে প্রশ্নগুলো সেভাবে দানা বাঁধছে না। দ্বিতীয় কারণ, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় কূটনীতির সাফল্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠলেও তা আলোচিত হলো গোপনে। চীন ছাড়া আর কারও সমর্থন পাকিস্তান পেল না। জাতিসংঘও বৈঠকের পর কোনো বিবৃতি বা অভিমত জানাল না। মুসলিম দুনিয়াও নীরব। ভারত তাদের অনুরোধ করেছে, তারা যেন ভারতের ‘গণতন্ত্র, বহুত্ববাদী চরিত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার’ পক্ষে থাকে। গোটা পৃথিবীকে ভারত বোঝাতে পেরেছে, কাশ্মীরে যা হয়েছে, তা সে দেশের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর চীন সফরে গিয়ে এই দাবি জানিয়ে বলে এসেছেন, নিয়ন্ত্রণরেখা, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত অপরিবর্তিত রয়েছে। এর অর্থ, রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে ‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীন ও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ বলে যে দাবি করেছিলেন, তা ছিল স্রেফ কথার কথা। জয়শঙ্কর চীনকে বোঝাতে চাইলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তৃতীয় কারণ, পাকিস্তানের বেহাল ও হতোদ্যম অবস্থা। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভঙ্গুর পাকিস্তান এখনো এমন কিছু করতে পারেনি, যা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মনোবল বাড়াতে পারে। 

কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে এটাই শেষ কথা নয়। এত বছরের ইতিহাসের নিষ্পত্তি ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে গেল মনে করা নিতান্তই বাড়াবাড়ি হবে। কাশ্মীরি মন এখনো অজানা। এতগুলো দশক ধরে উপত্যকার বিভাজন ছিল তিন ধরনের। প্রথম ভাগে ছিলেন সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়া রাজনীতিক, যাঁরা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও ভারতপন্থী ছিলেন। দ্বিতীয় ভাগে স্বাধীনতাকামীরা। তৃতীয় ভাগে পাকিস্তানপন্থী উগ্রপন্থীরা। প্রথাগত ভারতপন্থী রাজনীতি ও তাদের অনুগামীরা এত দিন ‘বাফার’ হিসেবে অস্তিত্ব জাহির করে এসেছে। রাজ্যের মর্যাদা ও অঙ্গহানির পর এই অংশের অবস্থান ঘুরে গেলে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কোন দিকে বাঁক নেবে, কেউ জানে না। কারণ, কাশ্মীরের মানুষকে অন্ধকারে রেখে এমন আচমকা এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা ছিল তাদের বোধের অগম্য। তারা নিজেদের প্রতারিত মনে করলে তার পরিণতি কী? 

আপাতত পরিস্থিতি বোঝাবুঝির পর্ব চলছে। কাশ্মীর উপত্যকা এখনো তার মনের ঝাঁপি খোলেনি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি