বায়ুশক্তির সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে

২০১৮ সালের শেষে ইউএসএইড বাংলাদেশের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউবেল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশের বায়ুশক্তি ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। স্বভাবতই দেশে এরপর আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইতিবাচক নানা তৎপরতা শুরু হবে। উল্লিখিত সমীক্ষায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুপ্রবাহের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে একটি উইন্ড ম্যাপ বা বায়ুপ্রবাহের শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাপূর্ণ ৯টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বোর্ড ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কাঠামোর অধীনে তিনটি পৃথক স্থানের জন্য (প্রতিটি ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুশক্তিচালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করতে বলেছে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, আগ্রহী প্রতিষ্ঠান আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি পৃথক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে চাঁদপুরের কচুয়া, খুলনার মোংলা ও কক্সবাজারের ইনানীতে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চুক্তির অধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে নির্ধারিত মূল্যে ২০ বছর ধরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেবে। 

বাংলাদেশের মোট প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন হওয়ার কথা। এর মধ্যে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের। প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল বা সোলার হোম সিস্টেমস থেকে। সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগের অধীনে বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্ত হয়েছে আরও প্রায় ৩৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সোলার প্যানেলনির্ভর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য।

ইতিমধ্যে দেশে স্থাপিত (ফেনী ও কুতুবদিয়ায়) উইন্ড টারবাইন থেকে বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য ১ মেগাওয়াটের কাছাকাছি মাত্র। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগ সফল হলে বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। সরকার আশাবাদী যে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা ১ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট। 

দ্য ওয়ার্ল্ড উইন্ড এনার্জি কাউন্সিলের প্রকাশিত ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কেবল গত বছর পৃথিবীতে ৫১ দশমিক ৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্য (স্থলভাগ ও সমুদ্রবক্ষে) স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে কেবল বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিশ্বে উৎপাদিত হয়েছে মোট প্রায় ৬০০ গিগাওয়াট ক্ষমতার বাণিজ্যিক বিদ্যুৎশক্তি। ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং ভৌগোলিক অবস্থান নিরিখে কোন দেশ কী পরিমাণ বিদ্যুৎ কোন ধরনের নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করবে, তা নির্ধারণ করার সুযোগ পায়। 

নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি প্রধান অবলম্বন। এখন পর্যন্ত বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ব্রাজিল, কানাডা ও ইতালির অবস্থান। ভারতে বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩৫ গিগাওয়াট। ২০২২ সাল নাগাদ ভারত সরকার বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে প্রায় ৬০ গিগাওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। সমুদ্রবক্ষে ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা পৃথিবীতে এখন কম নয়। 

চীনের শেনকুয়ান-১ তেমনি এক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা সমুদ্র উপকূলে ৪৬ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় ৭৩টি উইন্ড টারবাইন থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষম। যুক্তরাজ্যের নর্থ সি উপকূলে প্রায় ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ২০১২ সালে স্থাপিত হয়েছে ৫০৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ১৪০টি উইন্ড টারবাইন। নেদারল্যান্ডসের সমুদ্র উপকূলে প্রায় ৮৫ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় স্থাপিত ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার জেমিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রটি এখনো এককভাবে বৃহত্তম বায়ুশক্তিচালিত সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র। 

যেহেতু বায়ুপ্রবাহের গতির ওঠানামা উইন্ড টারবাইনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব ফেলে, সে কারণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হলে অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎশক্তি দ্রুত সরবরাহের দক্ষ সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা গড়তে হয়। নতুন প্রযুক্তির বিকাশ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎশক্তির বর্ধিত ব্যবহার সে কারণে জনপ্রিয় হচ্ছে। 

ড. মুশফিকুর রহমান খনি প্রকৌশলী এবং জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক