ইউরোপের ট্রাম্পবিরোধিতায় নামা উচিত

জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিতে এ মাসের শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ সফর করতে যাচ্ছেন। তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করা উচিত হবে, তা ইউরোপের নেতারা ঠিক করে উঠতে পারছেন না। ট্রাম্পের আগের সফরগুলোতে তাঁরা তাঁর সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুই ধরনেরই আচরণ করেছেন। তাঁরা ট্রাম্পের মন জোগানোর চেষ্টা করেছেন, তোষামোদি করেছেন, তাঁকে উপেক্ষা করেছেন, এমনকি তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করার বিষয়ে একমতও হয়েছেন। এত কিছুর পরও ট্রাম্পের একগুঁয়েমি কাটেনি। এখন ইউরোপীয় নেতাদের সামনে ট্রাম্পকে একটি জিনিস দেখানোই বাকি আছে। সেটি হলো: সরাসরি বিরোধিতা।

ট্রাম্প কোনোরকম বিবেকের দংশন ছাড়াই মারাত্মক সব পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং এখন তিনি আর্থিক শক্তি ও সামরিক হুমকি দিয়ে সেই কাজই করছেন। তিনি ইরান ও ভেনেজুয়েলাকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য ক্ষমতাধর দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন চাচ্ছেন। চীনের প্রবৃদ্ধি থামিয়ে কিংবা গতি কমিয়ে দিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি বাজার বন্ধ করে দিচ্ছেন, চীনা কোম্পানির কাছে মার্কিন প্রযুক্তিপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করছেন এবং চীনকে ক্রমাগত মুদ্রা কারসাজির হোতা বলে আখ্যায়িত করছেন।

ট্রাম্পের দিক থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগকেই যতটা না একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত বলা যায়, তার চেয়ে একজন অসংযমী ব্যক্তির হঠকারী সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইনপ্রণেতাদের মত নেই, এতে জনমতেরও প্রতিফলন নেই। ২৩০ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এক ব্যক্তির শাসনে এতটা ক্ষতির মুখে আগে কখনোই পড়েনি। প্রশাসনের যে-ই হোন না কেন, যিনিই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামান্যতম দ্বিমত পোষণের আভাস দিয়েছেন তাঁকেই ট্রাম্প সরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জেমস ম্যাটিসের মতো লোককেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে।

ট্রাম্প যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও অর্থবল বাড়ানোর চিন্তা থেকেই রাজনীতিতে এসেছেন, এ কথা এখন সবাই জানে। এর চেয়ে বড় কথা, অনেক বিশেষজ্ঞের মতেই ট্রাম্প মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। তিনি হুটহাট করে এমন ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন, যার প্রভাব সাংঘাতিক ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তিনি নিজেকে সংযত রাখতে অসমর্থ একজন ব্যক্তি। এসব কারণেই ইউরোপের নেতাদের ট্রাম্পের শক্ত বিরোধিতা করতে হবে, তাঁর মন জোগানোর চেষ্টা করা ঠিক হবে না।

জি-২০ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময় ট্রাম্প চীনের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের ‘বিরতি’ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার কয়েক সপ্তাহ পরই চীনের পণ্যের ওপর তিনি নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে বসেন। তিনি নিজেই নিজের কথা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। চীনের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রাসী আচরণের কারণে চীনসহ বহু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন তাঁর আচরণের কারণে ইউরোপের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

যে দেশটিই ট্রাম্পের কাছে নতিস্বীকার করতে অস্বীকার করছে, সে দেশকেই তিনি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমেরিকার সাধারণ মানুষ অসংযমী ও মারমুখী নয়, কিন্তু ট্রাম্পের উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবেই এই শ্রেণির মানুষ। তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ।

বোল্টন সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফর করে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট করার বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। ট্রাম্প ও বোল্টন যুক্তরাজ্যকে এতটুকু লাভজনক ছাড় না দিয়েই ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাঁরা প্রকাশ্য শত্রু, সেই ইতালির মাত্তিও সালভিনি থেকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান পর্যন্ত সবাই ট্রাম্প, বোল্টন ও পম্পেওর বন্ধু।

ইরানের ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাতের অভিলাষ চরিতার্থ করতে ট্রাম্প চেষ্টা করে চলেছেন। ইসরায়েল ও সৌদি আরবের দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতারা ট্রাম্পের ইরান-বিদ্বেষকে উসকে দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কী ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা ইউরোপীয়রা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। তারা জানে, বর্তমানে ইউরোপে বন্যার পানির মতো অভিবাসীদের ধেয়ে আসার প্রথম ও প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্র। জর্জ বুশের আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ এবং বারাক ওবামার লিবিয়া ও সিরিয়া যুদ্ধের কারণেই আজকের এই অভিবাসী সংকট তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবিবেচনাপ্রসূত হামলার খেসারত দিতে হচ্ছে ইউরোপকে (এবং অবশ্যই তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ মানুষকে)।

এখন ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক যুদ্ধ আরও খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে। তিনি তাঁর মিত্রদের নিয়ে ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সব পথ বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। ইরানের সঙ্গে বাইরের দেশগুলোর কোনো কোম্পানি যাতে ব্যবসা না করে, সে ব্যবস্থা করতে চাচ্ছেন। এটি জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। কারণ, এটি করা হলে ইরানের নিরীহ জনগণ দারিদ্র্যে ডুববে। এটি সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধ। ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষকে ঠিক একই কায়দায় ট্রাম্প সংকটে ফেলার কূটকৌশল অনুসরণ করছেন।

চুক্তি লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করে আসছে ইউরোপ। সরাসরি আইন ভেঙে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর ইউরোপ সায় দেয়নি, কিন্তু সরাসরি বিরোধিতা করতে তারা ভয় পেয়েছে। কিন্তু তাদের ভয় পাওয়াটা উচিত হয়নি। চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে একজোট হয়ে ইউরোপের সরব প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। মার্কিন ব্যাংকগুলোকে বাদ দিয়েও ইউরো, রেনমিনবি, রুপি এবং রুবলের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে সহজেই বাণিজ্য চালানো সম্ভব। মুদ্রা বিনিময়ের ঝামেলা এড়িয়ে পণ্যের বিনিময়ে তেল—এই কায়দায়ও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি পৃথিবীর অর্ধেক দেশকে ইরান বা ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না দেয়, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রেরই ক্ষতি হবে। এতে ডলারের দাম পড়ে যাবে, মার্কিন পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইরান, ভেনেজুয়েলা, চীন এবং অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাতে ইউরোপ যদি সায় দেয়, তাহলে তারা গোটা বিশ্বকেই বিপদে ফেলে দেবে। ইউরোপের নেতাদের বুঝতে হবে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বেশির ভাগ মানুষ ট্রাম্পের বিকারগ্রস্তদের মতো আচরণের বিরোধিতা করছেন। তাঁর বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে দেশটিতে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার মতো বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ট্রাম্পের এই আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ইউরোপীয় ও আমেরিকান নাগরিকেরা বিশ্বশান্তির পথকে সুগম করতে পারেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক