এমন বাংলাদেশ তো বঙ্গবন্ধু চাননি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার শোকাবহ দিবস ১৫ আগস্ট তারিখে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত কয়েকটি শিরোনাম: ‘চামড়ার দামে ধস: সরকারের নজরদারি নেই, ব্যবসায়ীদের কারসাজি’, ‘রড নিয়ে হামলা, ভিপি নুরুলসহ আহত চারজন’, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি: ঢাকা ও মুগদা মেডিকেলে মশা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে’।

ভেতরের পাতায় প্রকাশিত ছোট–বড় আরও কতগুলো শিরোনাম: ‘ঘুষের তহবিলে জমা পাঁচ কোটি টাকার হদিস নেই’, ‘পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি: ভোলায় ধর্ষণ মামলার দুই আসামি নিহত’, ‘ভাগনিকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় মামা খুন’, ‘উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ছাত্রীকে ব্লেড দিয়ে পোঁচ’, ‘রেল থানায় ধর্ষণের অভিযোগ: ওসিসহ অভিযুক্তরা আজও গ্রেপ্তার হননি’, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি: একদিনের ব্যবধানে রোগী আবার বাড়ল’, ‘ঈদযাত্রা নিয়ে কথা ও কাজে মিল নেই’, ‘নতুন ওয়ার্ডে কোরবানির বর্জ্য অপসারণ করা হয়নি’, ‘ঈদের ছুটিতে সারা দেশে নিহত ৩৫ ’। এরপর অনলাইনে প্রকাশিত আরেকটি শিরোনাম: ‘রপ্তানির নামে অর্থ পাচার: রপ্তানি না করেই তাঁর আয় ১৭৪ কোটি টাকা’, ‘রাজধানীর লালবাগে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন’।

এই সংবাদ শিরোনামগুলো বিরাজমান বাস্তবতার প্রতিফলন। এগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও অতিকথন। অদক্ষতা-অযোগ্যতা ও অতিকথনের সঙ্গেও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন অনেক ক্ষেত্রে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, অনেক জায়গায় রাস্তাঘাট ও রেল বেহাল দুর্নীতির কারণেই। বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণা সত্ত্বেও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন টিকে আছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তথা সুশাসনের অভাবের কারণে। 

তরুণ বয়সে আমাদের যাঁদের বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁরা জানি এমন বাংলাদেশ তো তিনি চাননি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটাই তাঁর ‘সোনার বাংলা’র ধারণা। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশ, ‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা)। এ জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে এবং আমাদের সহচর ও সহপাঠী অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণও দিয়েছিলেন। 

অনেকেরই স্মরণ আছে, ২০০১-০৬ সালের চারদলীয় জোট সরকারের ভয়াবহ অপশাসনের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও আমাদের এমনই একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি ‘দিনবদলের’ স্বপ্ন তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন: ‘সংকটের আবর্তে নিমজ্জমান অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী ও সুন্দর জীবন গড়ে তোলাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র ব্রত। আগামী ২০২০-২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর ২০২০ সালে হবে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আমরা ২০২০-২১ সাল নাগাদ এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে সম্ভাব্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম একটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করবে। একটি প্রকৃত অংশীদারমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন ও দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র।’ 

দিনবদলের সনদে শেখ হাসিনা দারিদ্র্য ঘোচানো ও বৈষম্য রুখে দেওয়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন: ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দপ্তরে গণ–অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।’ 

দিনবদলের সনদে আরও অঙ্গীকার করা হয়: ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে...বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে...বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর ও জেলখানায় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার সম্পন্ন করা হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে...নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা–সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে...রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে...প্রবাসী বাঙালিদের জাতি গঠনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে...দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসনিক সংস্কার, তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ই-গভর্নেন্স চালু করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা হবে...জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।’ 

উপরিউক্ত অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে মূলত বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেই বর্তমান সরকার উল্লেখযোগ্য সফলতা প্রদর্শন করতে পেরেছে। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত, অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও চরম ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া শ্রমিকেরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তথ্য অধিকার আইন গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তা আইনে পরিণত করা হয়। লাগামহীন ‘ক্রেনি ক্যাপিটালিজম’ বা ফায়দাতন্ত্রের বিস্তারের মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের লাগামহীন বিস্তার ঘটেছে। ধার করে অবকাঠামো উন্নয়নে বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের ফলে আমাদের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আয়ের বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বোপরি একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসনের অভাবে অর্জিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখেই তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলা দলের পক্ষ থেকে তাঁরই কন্যা জাতির কাছে উপরিউক্ত অঙ্গীকারগুলো করে ভোট নিয়েছিলেন, যা দুর্ভাগ্যবশত বহুলাংশে অপূর্ণই রয়ে গেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার উল্টো পথেই হেঁটেছে। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমেই। সুতরাং বর্তমান সরকারকে এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ পুরো জাতিকেই দিনবদলের সনদের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তাই আসুন, সবাই মিলে নিজেদের অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা আজ সর্বশক্তি নিয়োগ করি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালনকে অর্থবহ করি। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক