না পারি সইতে, না পারি রইতে

ঈদ, চামড়া, ডেঙ্গু, যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতি নানান ঝুটঝামেলার ডামাডোলে শিশু গৃহকর্মীদের মর্মান্তিক মৃত্যু আর আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের অগোচরে থেকে গেছে। ধানের দাম না পাওয়ায় হাজার হাজার নিঃস্ব ভাগচাষির একজন মো. সাজু মিয়া (ছদ্মনাম)। সাজু মিয়ার বাড়ি জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার কোনো এক গ্রামে। তিনি তাঁর শিশুকন্যাকে ধানমন্ডির ১০ তলা এক বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন স্রেফ ক্ষুধা থেকে বাঁচানোর জন্য। কন্যা হিয়া (ছদ্মনাম) তার মাকে ছাড়া জীবনে ঈদ করেনি। হিয়া এই ঈদে বাড়ি যেতে চেয়েছিল। গৃহকর্তা মমিনুল হক (ঠিক নাম) এ রকম আবদারে রাজি হননি।

হিয়ার চেয়ে বয়সে অনেক বড় লোকজন ঈদের সময় মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে ১৭-১৮ ঘণ্টা খরচ করে কীভাবে বাড়ির দিকে ছোটেন, তা আমরা দেখছি। হিয়ার শেষ আবদার ছিল ঈদের পরের দিন হলেও তাকে যেন মায়ের কাছে যেতে দেওয়া হয়। সেটাও হয়নি। হিয়া ঠিক করে সে শিকল ভাঙবে। শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ভোরে নিজের একটি ছোট মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা ও ওড়না নিয়ে ১০ তলা ভবনের ছাদে ওঠে। ছাদের রেলিংয়ের সঙ্গে ওড়না বেঁধে নামার চেষ্টা করলে নিচে পড়ে মারা যায় হিয়া। পুলিশ বলছে, হিয়ার বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। (নয়া দিগন্ত, ১৬ আগস্ট ২০১৯) এরপর যা যা হওয়ার, যেমন লাশ মর্গে পাঠানো, ময়নাতদন্ত, একটি অপমৃত্যুর ঘটনা লিপিবদ্ধ করা; কেউ চাইলে মামলা, না চাইলে সব চুকে গেল। 

আগের মাসে (১৩ জুলাই ২০১৯) নির্যাতন সইতে না পেরে দুই কিশোর গৃহকর্মী ধানমন্ডির ১৪/এ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে সেখান দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিল তারা। আট-দশ দিন আগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেট দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে ধরে এনে আচ্ছাসে বানানো হয় দুজনকে। এরপর ১২-১৩ বছরের শরিফ আর স্বপন আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। কাপড় শুকানোর দড়ি জোগাড় করে বাথরুমের রডের সঙ্গে বেঁধে সাততলা থেকে নামতে শুরু করে তারা। দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে যায় শরিফ, তার হাত–পা ও কোমর ভেঙে যায়। স্বপন ছয়তলা পর্যন্ত গিয়ে জানালার গ্রিল ধরে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় চিৎকার করতে থাকে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। 

সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদকর্মীদের জানিয়েছিলেন, দুই শিশুই তাঁদের জানিয়েছে যে বাড়ির লোকজন তাদের বেত দিয়ে মারধর করতেন, তাদের শরীরে মারধর ও নির্যাতনের আলামতও পাওয়া গেছে। শিশু দুজনের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। তাদের গৃহকর্তা ইট ব্যবসায়ী কিবরিয়ার বাড়িও সেখানে। (জনকণ্ঠ, ১৩ জুলাই ২০১৯)

সুনামগঞ্জে ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ভাসতে ভাসতে ঢাকায় আসা খাদিজার কপাল ভালো। তার কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়নি। ঢাকার কাকরাইলের (৩১ জুলাই ২০১৯) কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির পাশে ১৫ তলা একটি ফ্ল্যাটের ১০ তলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে গ্রিলে ঝুলেছিল মুক্তির আশায়। পুলিশ আর জনতার চেঁচামেচিতে তার গৃহকর্ত্রী লাভলী রহমান তাকে মুক্তি দেন। পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়। এর আগে মেয়েটি যখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গ্রিলে ঝুলছিল, তখন ওই গৃহকর্ত্রী (কথিত মানবাধিকার নেত্রী) নিজে ভেতর থেকে গ্রিলের দরজায় তালা মেরে দেন। (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০১৯) 

এই ঘটনার ঠিক আগের দিন ৩০ জুলাই ২০১৯ চকরিয়ার রিয়াদ যখন ছাদ থেকে লাফিয়ে মুক্তির ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করছিল, তখন ১০ তলা ভবনের দারোয়ানের চেষ্টায় সে বেঁচে যায়। দারোয়ান সাইদুল ইসলাম রিয়াদকে উদ্ধার করার পর ৯৯৯-এ কল দিলে পাঁচলাইশ থানার পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়। উদ্ধারের পর রিয়াদ জানিয়েছে, তাকে দুই মাস ধরে মারধর করেন ওই বাসার গৃহকর্ত্রী আইনজীবী শ্যামলী কাজমী। ছেলেটির হাতে কয়েকটি কামড়ের দাগসহ সারা শরীরে মারধরের অসংখ্য দাগ ছিল। (দৈনিক আজাদী, ২৯ জুলাই ২০১৯)

এগুলোই প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়, প্রতিদিন শিশু গৃহকর্মীরা নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নানাভাবে পালাতে গিয়ে আহত–নিহত হচ্ছে কিংবা আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। 

শেষ পর্যন্ত কী হয়? 

আপস হয়ে যায়, মামলা করেন না বা মামলা তুলে নেন গরিব-অসহায় মা-বাবা বা অভিভাবক। গত বছরের জানুয়ারি মাসে সিলেটের বাদামবাগিচা এলাকায় শেভরন তেল কোম্পানির কর্মকর্তা মতিউস সামাদ চৌধুরী ও লুৎফা বেগমের বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে শিশু গৃহকর্মী নাসরিন নিহত হয়। বন্যাপীড়িত সুনামগঞ্জের মেয়ে নাসরিনের লাশ দেখার নাম করে রাতেই ওসমানী হাসপাতালে হাজির হন স্থানীয় কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তাঁর উদ্যোগেই আপস হয়। গৃহকর্ত্রী লুৎফা বেগম এক লাখ টাকা দিতে সম্মত হন। সে রাতেই তিনি নাসরিনের মায়ের হাতে ২৫ হাজার টাকা দেন এবং বাকি টাকা ময়নাতদন্ত শেষে দেবেন বলে ওয়াদা করেন। (www.ntvbd.com/.../একতলার-ছাদ-থেকে-পড়ে-গৃহ.২২ জানুয়ারি ২০১৮) 

আগ্রহী পাঠকদের নিশ্চয় হ্যাপির কথা মনে আছে। মাহফুজা আক্তার হ্যাপি নামের ১১ বছরের একজন মেয়েশিশু ঢাকার মিরপুরে কালশীর সাংবাদিক কলোনি এলাকার রাস্তায় অচেতন অবস্থায় পড়েছিল (২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর)। খন্দকার মোজাম্মেল হক নামের এক ব্যক্তি তাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে থানায় নিয়ে যান। তার মাথা, হাত-পাসহ সারা শরীরে ছিল অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। বন্যাদুর্গত জামালপুরের শিশু মিরপুরের এক বাসায় কাজ করত। উদ্ধারকারী নিজে বাদী হয়ে নির্যাতনকারী দম্পতিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি প্রসঙ্গে আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার জানিয়েছেন, হ্যাপির মামলাটির নিষ্পত্তি হয়েছে। নির্যাতিত হ্যাপি পুলিশের কাছে নির্যাতনের কথা বললেও আদালতে বলেছে কেউ তাকে নির্যাতন করেনি, বরং নতুন জামাকাপড় দিয়েছে। খাবার দিয়েছে। (যুগান্তর, ২৯ অক্টোবর ২০১৮) আজ পর্যন্ত এসব শিশুকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে এল না, একটা আইন হলো না। দায়সারা নীতিমালা নিয়ে কি আমরা চুপ করে থাকব? 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক