সংস্কার কার্যক্রমের সংস্কার দরকার

সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকের ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এর সূত্র ধরে ব্যাংকিং খাতে যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

দেশে আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ব্যাংকিং খাতে অনেক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশের পেছনে ছিল বিশ্বব্যাংক। দু-একটির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি এবং অর্থানুকূল্যের ক্ষেত্রে ছিল জাইকা ও ডিএফআইডিসহ কিছু উন্নয়ন–সহযোগী সংস্থা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রজেক্টের কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এর বেশ সুফল আমরা দেখতে পেয়েছি। শ্রেণিকৃত ঋণ আমরা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করব কিংবা ইন্টারেস্ট অ্যাক্রুয়াল কীভাবে সামলাব, সেগুলো নিয়ে আমাদের বেশ কিছু কাজ হয়েছে। ল্যান্ডিং রিস্ক অ্যানালাইসিস, ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)—এসবের ফলও পাওয়া শুরু করেছি।

আবার পরবর্তী সময়ে আমরা বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প দেখেছি, যেটি এখনো চলছে। এ প্রকল্প আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যক্তিবর্গ, কর্মকর্তাদের দক্ষতা-সক্ষমতা কিছুটা বাড়িয়েছে।

এখন স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বিসমিল্লাহ বা অপরাপর কেলেঙ্কারিগুলো যে ঘটেছে, সেসবের জন্য দায়ী কে বা কারা। এতে সংস্কারে কি কোনো প্রভাব পড়েনি? আমি সোজাভাবে বলতে চাই, সেগুলো মোটামুটিভাবে কাজ করেছে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণ, অনাদায়ি বা খেলাপি ঋণকে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করব, সেই ক্ষেত্রেও আমাদের বেশ পরিবর্তন এসেছে। আমরা ঋণঝুঁকি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজটি করেছি বিআইবিএমকে সঙ্গে নিয়ে। তার ফলও আমরা পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এসে করলেন কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন। সেগুলোর কি একদমই ফল পাইনি? পেয়েছি। ট্রেজারি রিস্ক কীভাবে সামলাতে হবে, ক্যাপিটাল অ্যাডেকুয়েসি কীভাবে সামলাতে হবে এবং ঋণ কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে, সেসব আমরা জানতে পেরেছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নও ঘটেছে। তাহলে কেন অনেকেই বলছেন যে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকেরই লাইসেন্সিং বিধানগুলো ঠিক ছিল না। গলদটা কোথায়? কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষিত হওয়ার পরও পারছেন না? এ জায়গায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবাই যেন একটা নতজানু মনোভাব পোষণ করছেন। পছন্দ করেন না এমন অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু তাঁরা কিছু বলতে পারছেন না।

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। অধুনা নাম পরিবর্তনকারী প্রায় দেউলিয়া একটি ব্যাংকে আইসিবি নাকি ইক্যুইটি পার্টিসিপেট করেছে। যেখানে ক্যাপিটাল মার্কেটে তাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে তারা যেখানে আগের মতো মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চারগুলো চালাতে পারছে না, সেখানে তারা কীভাবে এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করল। তাদের ব্যালান্স শিটে দেখা যাচ্ছে, তারা ওই ব্যাংকে ইক্যুইটি দিয়েছে প্রিমিয়ামে। এই প্রিমিয়াম কাকে দেওয়া হয়েছে? এখানে বলা হচ্ছে, পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিও ওই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছে। তারা ওই অর্থ কোথায় পেল? তারা কি সবার মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ নিয়ে কাউকে কিছু না বলে ওই ব্যাংকে বিনিয়োগ করল? এটা কী বার্তা দেবে? বিশেষভাবে আমরা যখন বলছি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে না গিয়ে তাঁদের মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা উচিত।

ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডগুলোয় হঠাৎ করে কিছু পরিচালক যুক্ত হয়েছেন, মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। হোস্টাইল টেকওভার বা শত্রুভাবাপন্ন অধিগ্রহণ পৃথিবীর সব জায়গায় হতে পারে। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকের শেয়ার কেনা যায়। ওই শেয়ারের মূল্যমান অনুসারে কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়াও যায়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট একজনকে ওই পরিচালনা পর্ষদে যোগ দিতে দেওয়া হচ্ছে না। তার জন্য কার কাছে যেতে হবে? যেতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে কথা বলবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে। যেসব ব্যাংকে হোস্টাইল টেকওভার হয়েছে সেগুলো কি কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গিয়েছে, কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদকে কিছু বলেছে? কিংবা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ওই সব পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নোটিশ জারি করেছে যে কেন নতুন মালিককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না? সেখানে কেন আমরা অন্য বিশেষ কোনো সংস্থার তৎপরতা লক্ষ করেছি?

সংশ্লিষ্টজনের মতে, ব্যাংকিং খাতে আইনি বিধানগুলো ঠিক হচ্ছে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। যে প্রতিষ্ঠানের যে কাজ, তা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

যেসব দেশে আপাতভাবে অর্থনীতি এগোচ্ছে, রাজনীতিও মোটামুটি স্থিতিশীল আছে, সেসব দেশের সম্ভাবনা অনেক। তাহলে এসব দেশ শেষ পর্যন্ত কোথায় আটকে যায়? আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের কতগুলো দেশ এবং আফ্রিকার কিছু এগিয়ে থাকা দেশের হঠাৎ পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, যেসব দেশের অর্থনীতি মোটামুটি এগিয়ে গিয়েছিল এবং রাজনীতিও মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল, সেসব দেশ দুটি কারণে আটকে যায়। এক. আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও দুই. সামাজিক অস্থিরতা বা অনাচার। আমাদের দেশেও ইদানীংকালে এ দুটি বিষয়ের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এখানে আর্থিক খাতের দুর্বলতা প্রকট। জনাব মুহিত নিজেই বলেছেন, পরিচালকেরা লুটপাট করেছেন। একের পর এক ব্যাংকের মালিকানা বদল হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায় টাকা পাচ্ছে, সেটি যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

নামে-বেনামে কিংবা সুফলভোগী গোষ্ঠীর নামে পুরো ব্যাংকিং খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেটা যদি বের করতে না পারি, তাহলে কী সিআইবি সংস্কার হলো? আমরা সুফলভোগীদের মালিকানার (বেনিফিশিয়ারি ওনারশিপ) কথা বলছি, সেটার কী হলো। এই ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে এ ক্ষেত্রে বিএসইসিরও দায়দায়িত্ব রয়েছে। তাহলে তো এগুলো আসলে কার্যকর সংস্কার নয়। আমরা মনে করি যে ১০ শতাংশের ওপরে মালিকানা ধারণ রহিতকরণ, হোস্টাইল টেকওভারের গাইডলাইন না থাকা কিংবা মার্জার একুইজিশনের গাইডলাইন এখনো না থাকার কারণে যেকোনো লোক বা গোষ্ঠী যেকোনোভাবে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে পারছে।

নীতির দিক থেকে পুঁজিবাজারের কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। বিএসইসি আগের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু তাতে ম্যানিপুলেশন হবে না, কোনো একটি গোষ্ঠীর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যবহৃত হবে না, সেটা আমরা বলতে পারছি না। আরও আশঙ্কার বিষয়, খোদ মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব মহোদয়রা যখন বলেন, ‘সংস্কারের কথা ভুলে যান’। সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ‘এটা করা উচিত, কিন্তু আমার প্রয়োজনীয় সাহস নেই।’ তাহলে প্রয়োজনীয় সাহস দিতে আমাদের কী করা উচিত? এ জন্য সরকারে যারাই থাকুক না কেন, অর্থমন্ত্রী বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানগুলোকে সাহস দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। আমাদের জন্য বড় জরুরি নীতি পরিবেশের পরিবর্তন। এটাকে বলে সংস্কার।

মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক