দেশ কেনা, দেশ বেচা

ড্যান ওয়াসারম্যানের আঁকা এই কার্টুন দ্য বস্টন গ্লোব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯ আগস্ট ২০১৯
ড্যান ওয়াসারম্যানের আঁকা এই কার্টুন দ্য বস্টন গ্লোব পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯ আগস্ট ২০১৯

গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ। আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ গুণ বড়। ৮০ শতাংশ বরফে ঢাকা গ্রিনল্যান্ড জনবিরল দেশ হলেও এখানে রয়েছে অফুরন্ত মৎস্যসম্পদ, পৃথিবীর বিশুদ্ধতম পানি, বিরল প্রাণিবৈচিত্র্য এবং অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কিনতে চাইছেন ডেনমার্কের কাছ থেকে।

গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের একটি স্বশাসিত অঞ্চল। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা এর অনুমিত মূল্য ধরেছে এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক লাখ কোটি ডলার। তারপরও এটি বেচার কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না ডেনমার্ক।

গ্রিনল্যান্ডে স্মার্টফোন, নতুন প্রজন্মের কম্পিউটার আর ব্যাটারিচালিত গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থের বিশাল মজুত রয়েছে, রয়েছে ইউরেনিয়াম ও জিংক। গ্রিনল্যান্ড ক্রয় করতে পারলে শিল্পজাত খনিজ পদার্থের ওপর চীনের প্রাধান্য রুখে দেওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ গলে আর্কটিক অঞ্চলে যে নতুন নৌচলাচল রুট সৃষ্টি হতে পারে, তার নিয়ন্ত্রণও পাওয়া যাবে।

গ্রিনল্যান্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর ভূরাজনৈতিক অবস্থান। রাশিয়া আর আমেরিকার মাঝখানে আর্কটিক এই বিশাল ভূমি সামরিক স্থাপনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান। গ্রিনল্যান্ড ক্রয়ে আমেরিকার আগ্রহের অন্যতম কারণ এটিই।

গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়টি কতটুকু এগোবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ডেনমার্কের মতো একটি ধনী রাষ্ট্রের বিশাল অঞ্চল কিনে নেওয়ার কথা যে উঠেছে, এটিই নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক এবং রাশিয়ার সামরিক প্রভাবের দ্বন্দ্ব কত দূর পর্যন্ত গিয়েছে, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় এতে। পাওয়া যায় বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনের উদ্ভব আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠিত নর্ম ভেঙে যাওয়ার বর্তমান সময়ে ছোট দেশগুলোর নতুন ঝুঁকির আভাসও।

এই ঝুঁকির বাইরে নেই বাংলাদেশের মতো দেশও।

২.

শত বছর আগের ইতিহাসে ‘দেশ কেনাবেচার’ এমন উদাহরণ ছিল। আমেরিকা নিজেই ঊনবিংশ শতকে ফ্রান্স থেকে লুইজিয়ানা, স্পেন থেকে ফ্লোরিডা আর রাশিয়া থেকে আলাস্কা কিনে নিয়েছিল। অবিশ্বাস্য মূল্যে এসব ক্রয় আমেরিকাকে কীভাবে লাভবান করেছে, তার একটি উদাহরণ আলাস্কা ক্রয়। ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ছয় লাখ বর্গকিলোমিটারের আলাস্কা কিনেছিল মাত্র ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারে, বর্তমান অঙ্কে যা ১২৫ মিলিয়ন ডলারের মতো। অথচ আলাস্কাতে মজুত খনিজ তেলই রয়েছে ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের। এরপর ছোট ছোট কিছু দ্বীপ ও ভূমি আমেরিকায় অঙ্গীভূত হলেও গত ৭০ বছরে এমন ঘটনাও আর ঘটেনি।

গ্রিনল্যান্ড ক্রয় নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ তাই চমকে দেওয়ার মতো। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের সময় প্রথম গ্রিনল্যান্ড ক্রয়ের কথা ভাবা হয় ১৮৬০ সালের দিকে। ১৯৪৬ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দেন হ্যারি ট্রুম্যান—এ দাবিও করেন কেউ কেউ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ডিকলোনাইজেশনের যুগে এ কথা আর মুখে তোলেননি কেউ। আমেরিকা সময়ে সময়ে গ্রিনল্যান্ডের কিছু জায়গায় লিজ নিয়ে নতুন
সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কথা বলেছে। কিন্তু স্বাধীন দেশের গোটা একটা বিশাল অঞ্চল একেবারে কিনে নেওয়া হবে, এটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগে কেউ আর উচ্চারণ করেননি।

ট্রাম্প এটা করেছেন ডেনমার্কের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করার, এমনকি ইউরোপকে অস্বস্তিতে ফেলার ঝুঁকি নিয়েই। তিনি ডেনমার্ক সফরের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ডেনমার্কের রানির কাছ থেকে। ২ সেপ্টেম্বর তাঁর সেখানে যাওয়ার কথা চূড়ান্ত ছিল। ডেনমার্ক কেনার আগ্রহের কথা তিনি আগেভাগেই জানিয়ে দিলে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী এটিকে অবাস্তব আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আশা করছি, তিনি এটা সিরিয়াসলি বলছেন না।’

কিন্তু ট্রাম্প এটি সিরিয়াসলিই বলেছিলেন। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব জানার পর তিনি জানিয়ে দেন যে গ্রিনল্যান্ড বিক্রির বিষয়টি আলোচনা করতে রাজি না হওয়ার কারণে তিনি ডেনমার্ক সফরই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২১ আগস্ট তিনি আরও চরম একটি প্রতিক্রিয়া দেখান। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে ‘ন্যাস্টি’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং জানিয়ে দেন তাঁর নেতৃত্বে থাকা আমেরিকার সঙ্গে এভাবে কথা বলা প্রত্যাশিত নয়।

গ্রিনল্যান্ডকেন্দ্রিক বিতর্কে নতুন বিশ্বব্যবস্থার ছক তৈরিতে আমেরিকার মনোভাবও ফুটে ওঠে তাঁর ২১ আগস্টের টুইট থেকে। সেখানে তিনি বলেন, ‘ডেনমার্ক ন্যাটোর খরচ নির্বাহের জন্য তার জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্রদান করে। তারা একটি সম্পদশালী দেশ এবং তাই এটা অন্তত ২ শতাংশ হওয়া উচিত। আমরা ইউরোপকে রক্ষা করি, তবু ন্যাটোর ২৮টি দেশের মাত্র ৮টি ২ শতাংশ প্রদান করছে। আমেরিকা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি মাত্রায় করছে।’

গ্রিনল্যান্ড বিক্রয় বিষয়ে চাপ সৃষ্টির জন্য তিনি এর আগে সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। গ্রিনল্যান্ডে বহু বছর ধরে খনিজ আহরণসহ আরও অনেক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। ফলে সেখানকার খরচ নির্বাহ করার জন্য ডেনমার্ককে প্রতিবছর ৭০০ মিলিয়ন ডলার সাবসিডি দিতে হয়। ট্রাম্প এসব বলে গ্রিনল্যান্ড বিক্রয় করতে ডেনিশ কর প্রদানকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেছেন।

গ্রিনল্যান্ড কিনে ফেলার চমকপ্রদ প্রস্তাবটি ট্রাম্প দিয়েছেন কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণে ঢালাও নিষেধাজ্ঞা, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল তোলা ও জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণের পর। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, অসম বাণিজ্য, নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানা ধরনের চাপ অব্যাহত রাখবেন, তা এসব থেকে বোঝা যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এসব কার্যক্রম বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করবে। অন্য একটি দেশের মানচিত্র বদলে ফেলার মতো বড় মাপের ক্রয়ের যে চিন্তা আমেরিকা করতে পেরেছে, তা অন্য কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রও করতে পারে ভবিষ্যতে। এটি না হলেও চীন বা ব্রিটেনের মতো করে অন্য রাষ্ট্রের ভেতরের জমি, পাহাড়, বনভূমি কেনার প্রবণতা বাড়তে পারে। বাড়তে পারে এতে রাজি করানোর জন্য অন্য রাষ্ট্রে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা বা তাকে ধরে রাখার লক্ষ্যে নানা ধরনের হস্তক্ষেপ।

৩.

এসব ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ব্যবহার করার আগ্রহ শক্তিশালী দেশগুলোর রয়েছে বলে আমরা শুনি। এমনিতে কয়লা, পারমাণবিক শক্তি, জাহাজ-বর্জ্যসহ নানান ক্ষতিকর শিল্প স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। কিছুদিন আগে আগরতলা বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করার জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে ৫২ একর ভূমি চাইবে ভারত—এসব সংবাদ এসেছে পত্রিকায়। এ ছাড়া সেন্ট মার্টিনের মতো কিছু স্পর্শকাতর এলাকার দিকে চোখ আছে নানা দেশের—এসব খবরও মাঝেমধ্যে আমরা শুনি।

কর্তৃত্ববাদী ও স্বার্থান্ধ নতুন বিশ্বব্যবস্থায় এসব ঝুঁকি সম্পর্কে সরকারকে সচেতন থাকতে হবে। ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। এসব বিষয় খোলামেলাভাবে জনগণকে জানাতে হবে এবং বিভিন্নভাবে তাদের মতামত নিতে হবে।

সর্বোপরি, দেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে আলোচনার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যেমন: ভারত তার সুবিধার জন্য বাংলাদেশের মতো তীব্র ভূমিসংকটে থাকা দেশের জমি চেয়েছে। বাংলাদেশ বিনিময়ে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য ভারতের ভূমি ব্যবহারের স্থায়ী বন্দোবস্ত চাইতে পারে। দেশের স্বার্থ রক্ষায় চাইতে পারে আরও বহু কিছু।

নিজ দেশের স্বার্থের কথা সরকারকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে। ডেনমার্ক, ফিলিস্তিন বা মেক্সিকো—এদের কেউ আমেরিকার মতো পরাশক্তিকে নিজ কথা বলতে ছাড় দেয়নি।

রাষ্ট্র পরিচালনায় এটি যেকোনো সরকারের একটি পবিত্রতম দায়িত্ব।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক