শ্রীকৃষ্ণ: আঁধারে আলোর দ্যুতি

চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি নহুশের পুত্র। যযাতির যদু, তুর্বসুর, দ্রুহ্য, অণু ও পুরু এই পাঁচ পুত্র। এর মধ্যে যদু সবার বড়। শ্রীকৃষ্ণ এই যদুবংশে মহাত্মা দেবকীর গর্ভে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। বসুদেবের পুত্র বলে তিনি বাসুদেব নামেও ভক্তদের কাছে পরিচিত। সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থ ‘কালো’। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তাঁর ভক্তদের কাছে ‘জন্মাষ্টমী’ হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

সনাতন শাস্ত্রমতে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মর্ত্যে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্যে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিয় বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, 

‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্ ।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।’

—জ্ঞানযোগ ৭/৮ 

গীতার কথামতো ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো ভগবতপ্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ মানুষের ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদগুণ, সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণ-দুরাচার অত্যধিক বৃদ্ধি পায়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের জন্ম নিয়ে বলেছেন, ‘আমার জন্ম–মৃত্যু সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়, কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।’

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।’

যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে দুরাচারীর অত্যাচার ও নিপীড়নে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়্‌গুণ, যথা ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন ‘পূর্ণাবতাররূপে’ প্রকাশিত হন। তাঁর জন্মলীলাই জন্মাষ্টমী নামে অভিহিত ও স্মরণীয়।

যিনি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তিনিই ভগবান। বেদে তাঁর পরিচয় ব্রহ্ম। এত বড় যে তিনি আমাদের নাগালের বাইরে। আমাদের ষড়্‌ ইন্দ্রিয়, আমাদের ক্ষুদ্র মন, আমাদের সংকীর্ণ বুদ্ধি এসবের তিনি বহু ঊর্ধ্বে। তাঁকে পাওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে, তবে তাঁকে পাওয়ার জন্য ভক্তের নিরন্তর আকুলতা সৃষ্টিকর্তার মনেও দোলা না দিয়ে পারে না। এ সমস্যার সমাধান করলেন তিনি নিজেই নিত্য ও অনুগ্রহ শক্তির প্রেরণায় ‘অনুগ্রহায় ভূতানাং’। কৃপা করে তিনি এলেন এই ধূলির ধরায়, আমাদের দুয়ারে। ভগবান অবতরণ করলেন মানুষের ঘরে, করুণায় বিগলিত হয়ে। সীমাহীন ধরা দিলেন সীমানার কিনারে, মানুষ রূপে। পরম ব্রহ্ম শুদ্ধাভক্তি দেবকী ও শুদ্ধসত্য বাসুদেবের ঘরে কৃষ্ণ রূপে পুত্র পরিচয়ে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিও। আমি বুদ্ধিমানদিগের বুদ্ধি এবং তেজস্বীগণের তেজস্বরূপ।’ (গীতা ৭/১০)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেছেন, ‘যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে, আমি সেইভাবে তাহাকে কৃপা করি।’ (গীতা ৪/১১)

মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাঁকেই ভগবান বলে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মনীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাসিত হয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, সে নামে তিনি সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন।

তারাপদ আচার্য্য: নারায়ণগঞ্জ দেওভোগ সাধু নাগ মহাশয় আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক