ফেসবুক মোছে না কিছুই


ওটা দিতে হবে

‘শুধু বিঘে–দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।”’

ডেনমার্কের একটা স্বশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডেনমার্ক এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। তাই ডেনমার্কে নিজের সফরের কর্মসূচি বাতিল করে দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তাই তো। আমেরিকার ওই গ্রিনল্যান্ড দরকার। তাতে ইউরোপে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে গ্রিনল্যান্ডের তুষার গেলে খনিজ সম্পদে অত্যন্ত ঋদ্ধ দেশটির সম্পদগুলো আমেরিকার কাজে লাগানো যাবে। সেই যে আমেরিকানরা প্রশ্ন তুলেছিল, আমাদের তেলসম্পদ কেন মধ্যপ্রাচ্যের বালুর নিচে? এখন তাদের প্রশ্ন, আমাদের সম্পদ কেন গ্রিনল্যান্ডের তুষারের নিচে?

তারপর একদিন আমেরিকা বলবে, ডেনমার্ক, তোমরা কেন আমাদের সম্পদে হাত দিতে দিচ্ছ না? বেটা সাধুবেশে পাকা চোর।

ডেনমার্ক তখন মনের দুঃখে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা থেকে পড়তে থাকবে—

‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

...

আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।’

তবে ডেনমার্ক নিশ্চয়ই উপেনের মতো হতদরিদ্র নিঃস্ব, রিক্ত, ক্ষমতাহীন, অসহায় নয়। তারাও ছেড়ে কথা কবে না। দেখা যাক, কী ঘটে!

হীরা দিয়ে পৃথিবী মোড়া যাবে

হীরা দিয়ে নাকি সারা পৃথিবী মুড়ে দেওয়া যাবে। প্রথম আলো লিখেছে, পৃথিবীতে আছে এক হাজার ট্রিলিয়ন হীরা। আমি গণিতে দুর্বল। আমার হিসাবে এক শ কোটি লাখ টন হীরা আছে। এক টন নয়। লাখ টন নয়। কোটি টন নয়। এক শ কোটি টনও নয়। এক শ কোটি লাখ টন। অর্থাৎ, সব হীরা তোলা হলে আমার ভাগে পড়বে (গড়ে) ১৫ হাজার টন হীরা। ১৫ হাজার টন হীরা আমি রাখব কই, এ দিয়ে আমি কী করব? সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর সিনেমায় যেমন একটা পরশপাথর আশপাশের সবকিছুকে সোনায় রূপান্তরিত করে জীবনযাপন ও বেঁচে থাকা অসম্ভব করে দিয়েছিল, তেমনিভাবে সব হীরা উত্তোলিত হলে পৃথিবীতে হীরা হবে বালুর চেয়েও সস্তা। মাটির চেয়েও সস্তা। পানির চেয়েও সস্তা। এমনকি এ বছর কোরবানির ঈদে পশুর চামড়া যত সস্তা হয়েছিল, হীরা হবে তার চেয়েও সস্তা।

আমার ধারণা, সামনের বছর ঈদুল আজহায় পশুর চামড়া বিক্রি হবে না, বরং তা নিয়ে যাওয়ার জন্য কোম্পানিকে উল্টো টাকা দিতে হবে; তেমনি ভবিষ্যতে হীরা হবে একটা ঝামেলাপূর্ণ বর্জ্য, যা ফেলে দেওয়ার জন্য বিশেষ কোম্পানি ডাকতে হবে আর তাদের টাকা দিয়ে তাদের হাতে হীরকবর্জ্য তুলে দিতে হবে। তারা মিউনিসিপ্যালিটির বর্জ্যবাহী ট্রাকের মতো যান এনে নাকে রুমাল চেপে হীরা তুলে নিয়ে চলে যাবে।

কাজেই যার কাছে যত হীরা আছে, আজই ফেলে দিন। কেউ তো কিনবে না, তাই বলতে পারছি না বিক্রি করে দিন।

ফেসবুকে মোছে না কিছুই

ক্লিয়ার হিস্ট্রি নামের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা ফেসবুক দিয়েছিল বছরখানেক আগে। সম্প্রতি সেই সুবিধা চালু করা হয়েছে আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। তবে ফেসবুক বলছে, আসলে ফেসবুকে মোছে না কিছুই। সবই সার্ভারে থেকে যায়। এটা ফেসবুক ব্যবহারকারীর জন্য শুধুই সান্ত্বনা।

ব্যবহারকারী ভাববেন, সব মুছে দিয়েছি। আসলে কিছুই মোছে না। সবই থেকে যায়।

তবে কেবল ফেসবুকে বা অনলাইনে আমরা যা করি, তার সবকিছুই থেকে যাচ্ছে, ব্যাপার তা–ই নয়।

আমরা অফলাইনে যা কিছু করছি, সেসবও কিন্তু থেকে যাচ্ছে।

একটা ছোট উদাহরণ দিই। বাস্তব উদাহরণ। স্টিফেন হকিং কথা বলতে পারতেন না, শরীর নাড়াতে পারতেন না। শুধু চোখের পাতা ফেলে তিনি কম্পিউটার চালাতেন। এভাবে তিনি বই লিখেছেন।

পরে চোখের পাতা নাড়ার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেন। তখন একটা কম্পিউটার তাঁর মস্তিষ্কের ভাবনা পড়ে ফেলত। এভাবে তিনি সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছেন। এমনকি শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। মানে, একজন শ্রোতা প্রশ্ন করলেন, হকিং শুনলেন। তিনি উত্তরটা ভাবলেন। সেটা কম্পিউটার বলে দিল। মানে, মাথার ভাবনা কম্পিউটার পড়তে পারে।

আমি সারা জীবন কী করেছি, আমার মাথার হার্ডডিস্কে জমা আছে। এটা স্ক্যান করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু তার চেয়েও বৈপ্লবিক হবে, আমাদের সব ক্রিয়াকর্ম মহাজাগতিক হার্ডডিস্কে ধরা আছে। সেখান থেকে বের করে এটা একদিন দেখা যাবে। টাইমমেশিনও হয়তো এসে যাবে।

ইতিহাস একদিন আমাদের প্রতিটি ক্রিয়াকর্মের বিচার করবে। আজকে যা খুশি করছি এবং ভাবছি, এসব উদ্‌ঘাটিত হবে না। কিন্তু এসবও উদ্‌ঘাটিত হবে।

ইতিহাস লেখে বিজয়ীরা। ক্ষমতাবানেরা। দাবার ছক উল্টে গেলেই উল্টো-ইতিহাসও বেরিয়ে আসে। আসবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক