তদন্তকে স্বাগত জানাই পদত্যাগের সুযোগ নেই

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
>

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির তদন্তের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন, এটা কীভাবে শুরু ও শেষ হয়, সে জন্য আমরা অপেক্ষা করব। তবে তিন বিচারপতির পদত্যাগের সুযোগ নেই। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, তিনজনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া অবশ্যই একটি ইঙ্গিত অন্যদের জন্য, যাঁরা নিজেদের সঠিক পথে পরিচালনা করছেন না। মন্তব্য করুন।

আনিসুল হক: আমি সত্যি সত্যি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে আপনার মনে থাকবে যে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জহুরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের বিষয়ে আপনাকে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম।

প্রথম আলো: প্রথম আলোয় সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল (১৮ মে, ২০১৯)। ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবরে হাইকোর্ট (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত) রিটকারী এম আর ট্রেডিংয়ের মিজানুর রহমানের অনুকূলে আদেশ দেন। এতে ১৩৬ কোটি টাকার ডিক্রি, ব্যাংক ঋণের টাকা সমন্বয়ের পর সম্পত্তি বিক্রির বাদ বাকি ৪৮ কোটি টাকা এবং বন্ধকি আড়াই লাখ বর্গফুট আয়তনের বহুতল ভবন ফেরত দিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর ডিক্রি জারি করার জন্য ঢাকার অর্থঋণ আদালতকে নির্দেশ দেন। বাদীর আইনজীবীদের অন্যতম সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। অর্থঋণ আদালত অনুরূপ আদেশ দানের পরপরই ১৬ নভেম্বর ২০১৭ হাইকোর্ট থেকে মূল মামলা তুলে নেওয়া হয়। এর পর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করেন এবং বাদীকে এক কোটি টাকা জরিমানা করেন। জরিমানার টাকা তিনি জমাও দিয়েছেন।

আনিসুল হক: এখন সেই কারণে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে...। দেখুন বিচার বিভাগ স্বাধীন। এখন প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটা আমি জানি না। তাই সেখানে আমার কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি দেশের আইনমন্ত্রী। আমি যদি মন্তব্য করি, তাহলে তদন্তে তার একটা প্রভাব পড়তে পারে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি তাঁর অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে কী কথা বলে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তার আমি সম্পূর্ণটা জানি না। একজন বিজ্ঞ বিচারপতির সম্পর্কে যদি কোনো তদন্ত হয়, তাহলে দায়িত্ব পালনের সময় নিশ্চয়ই তিনি ‘কম্প্রোমাইজড’ হয়ে যান। তাই প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপ সঠিক। আমরা এখন দেখব প্রধান বিচারপতির তদন্ত কীভাবে হয়। সমস্যা কিছু আছে। কিন্তু তদন্ত করতে কোনো সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয় না। ইনহাউস ইনভেস্টিগেশন সব সময় হতে পারে।

প্রথম আলো: সেটা কি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের আলোকে?

আনিসুল হক: ওই রায়ের বিরুদ্ধে একটি রিভিউ বিচারাধীন রয়েছে। সেটা বাদ দিয়েই আমি বলতে চাই, প্রধান বিচারপতি তাঁর পজিশনের কারণেই এমন তদন্ত করতে পারেন। শুধু বিচার বিভাগ কেন, সুষ্ঠু গভর্ন্যান্সের জন্য জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার কাছে অভিযোগ এসেছিল, সেটা আমলে নিয়ে তিনি তদন্ত করবেন। সেই তদন্ত করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। এই তদন্তে কী বেরিয়ে আসে, সেই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটা আমরা দেখব।

প্রথম আলো: তর্কিত ওই রিটের বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে একটা তিরস্কার আছে।

আনিসুল হক: আমি যদি সেই মামলার রায় বা বিষয়বস্তুতে ফিরে যাই, তাহলে প্রথমেই বলব, কখনোই কোনো রিটে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়ার সময় কাউকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিকার দেওয়া যাবে না। আপিল বিভাগের এই যে প্রতিষ্ঠিত অভিমত, সেটা তো হাইকোর্টকে মানতে হবে। আলোচ্যে ক্ষেত্রে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিকার দেওয়া হয়। পরে শুনানি ছাড়াই রিটটি প্রত্যাহার করে নেয় বাদী।

প্রথম আলো:  এর আগেও সুপ্রিম কোর্টকে তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করার ক্ষমতা আপনাদের ছিল। কতটা প্রয়োগ করেছেন? ষোড়শ সংশোধনীতে—

আনিসুল হক: প্রথমত, বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, আমরা সেখানে ফিরতে চাই। দ্বিতীয়ত, যারা অন্যায় করবে, তারাই বিচার করবে, সেই অন্যায়ের বিচার হয় না। প্রমাণিত অসদাচরণ এবং অসামর্থ্যের কারণে বিচারপতিদের সরানোটা তাদের হাতেই রাখার অগণতান্ত্রিক বিধান ১৯৭৭ সালে যুক্ত করা হয়েছিল। সেটা আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছে আনতে চেয়েছি। একজন বিচারপতির পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই পদটি নিয়ে উইলি–নিলি খেলা যায় না।

প্রথম আলো: ষোড়শ সংশোধনীর রায় কিন্তু কার্যকর রয়েছে, স্থগিত হয়নি।

আনিসুল হক: না, তা হয়নি। তবে এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও নেই। তার কারণ রায়টি রিভিউয়ের মধ্যে রয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের চারটি উপ–অনুচ্ছেদ ছিল, ১৯৭৭ সালে বেআইনিভাবে আনা ৯৬ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছিল আটটি উপ–অনুচ্ছেদ। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে পদত্যাগসংক্রান্ত উপদফাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়নি।

প্রথম আলো:  যে তিনজন এখন তদন্তাধীন তাঁরা এখন চাইলেও পদত্যাগ করতে পারছেন না?

আনিসুল হক: এটা সংবিধানে নেই। তাই পদত্যাগ করার স্কোপ (সুযোগ) নেই। সে কারণে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ পিটিশন ও তার দ্রুত শুনানি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

প্রথম আলো: আপনি কি সেটা এ বছরই নেবেন?

আনিসুল হক: ২৯ আগস্টে কোর্ট দীর্ঘ অবকাশে যাচ্ছেন। খোলার পরেই আমরা শুনানির জন্য আদালতের দ্বারস্থ হব, ইনশা আল্লাহ। তবে নিয়োগদাতা সর্বদা নিয়োগপ্রাপ্তকে অপসারণ করতে পারেন। 

প্রথম আলো: কিন্তু সাংবিধানিক পদধারীদের অপসারণের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে।

আনিসুল হক: সেগুলোর মধ্যে আমি নিশ্চয়ই যাব না। আমি প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই। তার কারণ আমরা এই প্রথমবার একটা তদন্তের আশ্বাস পেয়েছি। সুপ্রিম কোর্ট ইজ দ্য সুপ্রিম ইনস্টিটিউশন। যেখান থেকে জনগণ ন্যায়বিচার পেয়ে থাকেন। তাই ‘জাস্টিস ডেলিভারির’ জায়গায় চুল পরিমাণ কোনো সমস্যা থাকবে, সেটা আমরা চাই না। সে কারণে তদন্ত করার এই যে আশ্বাস, আমি আবারও বলছি, এই পদক্ষেপকে আমি সাধুবাদ জানাই।

প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের উদ্যোগ কি এই প্রথম নিলেন?

আনিসুল হক: আপনারা গবেষণা করতে পারেন। এর আগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দু–চারটি  তদন্ত করেছেন। জাল সনদ ও ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার মামলায় তদন্ত শুরুর পরে যথাক্রমে বিচারপতি ফয়জি ও শহিদুল পদত্যাগ করেছিলেন। লিফলেট বিতরণের ঘটনায় বিচারপতি মুজিবুর রহমান অবশ্য খালাস পেয়েছিলেন।

আজ যদি তাঁরা (তিনজন) কর্মরত থাকতেন, আর তদন্তকাজ চলত, তাহলে দুই রকম সমস্যা হতো। বিচারপ্রার্থীরা তাঁদের কাছে বিচার পাওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, আবার সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় থাকতেন। তখন বিচারকার্য পরিচালনায় একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারত।

প্রথম আলো: ওই রিটের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে কি বার কাউন্সিলের কাছে পদক্ষেপ আশা করেন? 

আনিসুল হক: (হাসি) এ ব্যাপারে আপনি জানেন, আমি কেন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

প্রথম আলো: ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে দেশের ইতিহাসে প্রথম একটা ইনহাউস তদন্ত কমিটি (প্রধান বিচারপতি ও পরের দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সমন্বয়ে) করেছেন। তাঁরা লিখিতভাবে জানতে চাইবেন, সংশ্লিষ্টরা লিখিত উত্তর দেবেন। এটিই এখন তদন্ত করার আইন। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি কি না, আইনের আপনগতি এই পথেই যাবে?

আনিসুল হক: ষোড়শ সংশোধনীতে আমরা সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিটির ব্যবস্থা রেখেছিলাম।

প্রথম আলো: একই সঙ্গে দুদক কি তদন্ত করতে পারবে? দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, তিনি মনে করেন আইন তাঁকে কর্মরত বিচারপতির বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার দিয়েছে।

আনিসুল হক: সব দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার ক্ষমতা দুদকের আছে। দুদক আইনে এমন কোনো বিধান নেই যে অমুকের ক্ষেত্রে আপনি তদন্ত করতে পারবেন আর অমুকের ক্ষেত্রে তদন্ত করতে পারবেন না। এটা হচ্ছে একটি দিক। এ বিষয়টির আরেকটি দিক হচ্ছে, আমি অপেক্ষা করব মাননীয় প্রধান বিচারপতি কী করে এই তদন্ত শুরু ও সম্পন্ন করেন। আমি তার আগে কোনো কথাই বলতে রাজি না।

প্রথম আলো: একই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট ও দুদকে দুটো প্রসিডিংস (তদন্ত) একত্রে চলতে পারে কি না? আর কর্মরত বিচারপতির বিষয়ে—

আনিসুল হক: এ বিষয়টি কিন্তু একটু বোঝার দরকার আছে। তদন্তের জন্য আপনি যে সিস্টেম বেছে নেন না কেন, আমরা যেমনটা ষোড়শ সংশোধনীতে রেখেছিলাম, তেমন তদন্ত কমিটি যাতে সুধীজন থাকবেন, সেটা হয়তো এখানে শেষ কথা নয়। যদি ইনহাউস কমিটির তদন্তেও অপসারিত হন, তারপরেই কেবল দুদক তদন্ত শুরু করতে পারবে। তার আগে নয়। 

প্রথম আলো:  তার মানে আপনি বলতে চাইছেন অপসারণে প্রথমে আসবে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত?

আনিসুল হক: অবশ্যই।  প্রথমেই দুদক নয়। কারণ আমরা সংবিধানে বলে দিয়েছি এইভাবে এই প্রক্রিয়ায় মাননীয় বিচারপতিকে সরানো যাবে।

প্রথম আলো: উচ্চ আদালতের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর এখতিয়ার আপনার আছে। সেটা আপনি কতটা অনুশীলন করেছেন? নির্দিষ্টভাবে বলুন।

আনিসুল হক: আমি শুধু আইনমন্ত্রী নই। আমি এ দেশের একজন নাগরিক। যদি অভিযোগ পাই তাহলে আমি অবশ্যই তা মাননীয় প্রধান বিচারপতির নজরে নেব। আর সেটা দেশের স্বার্থে।

এখন পর্যন্ত আমার কাছে এমন অভিযোগ আসেনি, তাই কেন অভিযোগ করতে যাব।

প্রথম আলো: সাংবিধানিক পদধারীদের জবাবদিহির ক্ষেত্রে দেশে একটা প্রশাসনিক অচলাবস্থা বা সাংবিধানিক শূন্যতা চলছে কি না?

আনিসুল হক: আপনি বলতে পারেন, অর্ধেক গ্লাস খালি। আর আমি বলব অর্ধেক গ্লাস সম্পূর্ণ। তবে একদম যে শূন্যতা চলছে না, তা নয়, কিছুটা তো শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে একটা সঠিক অবস্থানে আসা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। সে জন্যই আমরা এই রিভিউ পিটিশনটা আদালত খোলামাত্রই তাড়াতাড়ি শুনানির জন্য পদক্ষেপ নেব।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আনিসুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।