এক নিরোই আমাজন ধ্বংসে যথেষ্ট

জায়ার বোলসোনারো।
জায়ার বোলসোনারো।

জায়ার বোলসোনারো। ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট। ‘দক্ষিণ আমেরিকার ট্রাম্প’ নামে পরিচিত। ট্রাম্পের মতোই তিনি বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, কার্বন নিঃসরণ—এগুলো সব ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’। তাঁর নিজেরও মিলিয়ন ডলারের গাছ কাটা ও কাঠ রপ্তানির ব্যবসা ছিল। বেনামে এখনো আছে। আগুনে আমাজন ধ্বংস বিষয়ে তিনি নির্বিকার তো বটেই, উল্টো মশকরা করে বলেছেন, ‘আগে আমাকে লোকে চেইন-করাত নামে চিনত, এখন আমি নিরো, আমাজনে আগুন লাগিয়ে বাঁশি বাজাই।’

কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অসংবেদনশীল হলে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট বলতে পারেন, ওসব কিছু না। কার্যত গরুর খামার বানাতে আগুন দিয়ে বন উজাড় করছে। তাঁর নিয়মিত বিরক্তি পরিবেশবাদীদের ওপর। বলেন, ওদের যন্ত্রণায় গাছ কাটা যাচ্ছে না। নির্মাণ-কাঠের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় ব্রাজিলের অর্থনীতি মার খাচ্ছে। র‍্যাঞ্চ বানানো না গেলে গরু চরবে কোথায়? গরুর গোশত রপ্তানির আয় কমে গেলে ব্রাজিল যে আরও গরিব হয়ে পড়বে। উন্নয়ন হবে না। গোমাংস ও শূকরের মাংস রপ্তানিতে ব্রাজিল এক নম্বর দেশ। উন্নত দেশগুলোর জনগণ গোমাংসের আসল ভোক্তা। ‘ফাস্ট ফুড’–এর মূল উপাদান গোমাংস। অর্থনীতিতে গোমাংসের প্রভাব এতই বেশি যে ‘বার্গার-নেশার অর্থনীতি’ বা ‘বার্গার-অর্থনীতি’ প্রত্যয় দুটিও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। পশ্চিমের বার্গার-নেশার চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সালেও ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন গোমাংস রপ্তানি করেছে ব্রাজিল। এই রপ্তানির আকার ২০১৭ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।

বাণিজ্যিকভাবে গরু পালনের ক্ষতিকর দিকগুলো মারাত্মক। আমাজনের ৪ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার ইতিমধ্যেই গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। নৃবিজ্ঞানী রবিন্স এটিকে বলেছেন ইন্ডাস্ট্রি বা কারখানা, কৃষি বা পশু পালন নয়। যে পদ্ধতিতে বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য দ্রুততম সময়ে গবাদি থেকে গোমাংস রপ্তানি করা হয়, তার সঙ্গে রবিন্স কারখানার উৎপাদনের মিল দেখেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের রয়েসয়ে বলা তথ্যমতেই ব্রাজিলে ২০১৮ সালে গরুর অব্যবহৃত হাড়-অস্থি-মজ্জা রয়ে গিয়েছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। যেভাবে এই শিল্প বেড়ে উঠছে, তাতে ২০২৮ সাল নাগাদ বর্জ্য আবর্জনার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় তিন মিলিয়ন মেট্রিক টনে। এই আবর্জনার পরিণতি নিঃসন্দেহে উত্তরোত্তর পরিবেশ বিনাশ। বর্জ্য গিয়ে মিশবে নদীতে, সুপেয় জলের উৎসে, মাটিতে। বিপন্ন হতেই থাকবে মানুষের জীবন, বন্য পশু ও প্রাণিসম্পদ।

গরমের সময় আমাজনে প্রতিবছরই আগুন লাগে—কথাটি সত্য। সব বনেই লাগে। কিন্তু এই বছর মাত্র আট মাসেই ৭৩ হাজারের মতো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবি ও তথ্য পর্যালোচনা করে জানায়, এই বছরে বনে আগুন লাগার সংখ্যা এবং ব্যাপ্তি গত বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি। সারা পৃথিবীর জন্যই এই তথ্য অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। কিন্তু বোলসোনারোর ভয় তো নেই–ই, উল্টো প্রতিষ্ঠানটির ওপর রাগ ঝাড়ার কমতি রাখেনি। বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠানটিকে সরাসরি ‘মিথ্যুক’ও বলেছেন। প্রতিষ্ঠানটি তবু থেমে নেই। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি দেখিয়েছে যে মাত্র পাঁচ দিনে, ১৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত আরও ৯ হাজার ৫০০টি স্থানে নতুন করে আগুন লেগেছে।

কার্বন নিঃসরণ কমানোই শুধু না, পৃথিবী গ্রহের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের সরবরাহই আসে আমাজনের চিরহরিৎ বন থেকে। সে কারণে আমাজনের সুরক্ষায় প্যারিস চুক্তিতে ব্রাজিলের প্রতি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা আছে। জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো বিশাল অঙ্কের আর্থিক সহায়তাও দিয়ে থাকে। আমাজন সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় জার্মানি ও নরওয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থলগ্নিও করেছে। সে কারণে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বোলসোনারোর নির্বিকারত্বের সমালোচনা করেন। বোলসোনারোকে দায়িত্ব-সচেতন করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রাজিলের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের কথা ভাবুক—এ রকম পরামর্শও দেন মাখোঁ। বরাবরের মতোই বোলসোনারো ফেটে পড়েছেন রাগে। আমাজন-চিন্তা বাদ; এখন তিনি মাখোঁবিরোধী ক্ষোভ ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতেই বেশি ব্যস্ত।

উগ্র ডানরা এ রকমই। সারা বিশ্বেই উগ্র ডান পপুলিস্টদের রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্তির সমানুপাতে পরিবেশ ও বন ধ্বংস হওয়াও বাড়ছে। তারা ব্যবসাই শুধু বোঝে; জিডিপি-জিএনপির তির সামান্য ওপরে উঠল কি না, সে চিন্তায় প্রাণপাত করে কিন্তু উদ্ভিদ, প্রাণ ও জীববৈচিত্র্যের টিকে থাকা না–থাকার ধার ধারে না। ‘প্রকৃতির ধারণক্ষমতা’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ইত্যাদি ধারণাগুলো তারা হেঁয়ালি বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের রোমান্টিসিজম মনে করে।

পরিবেশবাদী ও জনবাদী সংগঠনগুলো বলছে, এবারের আগুন লাগানো বড় করপোরেশনগুলোর ইচ্ছাকৃত কাজ হতে পারে। সে রকম হলে বোলসোনারোও যে এই কীর্তির বড় অংশীদার, তাতে সন্দেহ থাকে না। এত সন্দেহের কারণ, চারটি বড় বহুজাতিক আমাজন, মাইক্রোসফট, নভেলিস ও ফরচুন-৫০০ ভুক্তকোম্পানি এফআইএস ব্রাজিলে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বিনিয়োগে আগ্রহী এই চার কোম্পানি ব্রাজিলের অর্থনীতি চাঙা করে তুলতে পারলে আমাজনের সাফ করা জঙ্গলে খনিজ উত্তোলনসহ যেকোনো নতুন অর্থকরী কর্মকাণ্ডের খরচও বহুগুণ কমে আসবে। সামনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের হাতছানি। র‍্যাঞ্চিং ছাড়াও খনিজ উত্তোলন, তাপ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণের লোভে দৈত্যকার করপোরেশনগুলোও যে এই বন উজাড়ের অংশীদার নয়, তাই-বা কে বলবে?

এদিকে চীন ব্রাজিলের কাছ থেকে প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন টন সয়াবিন আমদানি করতে চাইছে। লোভনীয় প্রস্তাবে ব্রাজিল এক কথায় রাজি। কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায় চীন কানাডার ক্যানোলা ও সয়াবিন নিষিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি ট্রাম্পও চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। নির্দেশনা কার্যকর হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে। জবাবে চীন মার্কিন সয়াবিন আমদানিও নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যবসা-সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়তা দিয়েছে যে ব্রাজিলের সয়াবিনে বিনিয়োগ করলে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে। আরও নানা রকম অতিরিক্ত প্রণোদনাও দেওয়া হবে। চীনের প্রধান তিনটি কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক ব্যাংক আমদানিকারকদের সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়ঋণ দিচ্ছে। প্রাণ-পরিবেশের তোয়াক্কা না করার কারণে কুখ্যাত চীনের কফকো এবং বহুজাতিক কারগিল, এডিএম, বুঞ্জ, লুই দ্রেফ্যু ইত্যাদি নতুন সয়াবিন সরবরাহ ব্যবস্থার ৫২ শতাংশ ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে। সয়াবিন চাষের জন্য হাজার হাজার একর ভূমি দরকার। আমাজনেই আছে সে রকম মোক্ষম ও যথার্থ জমি। তাই পরিবেশবাদীদের অনেকেই দুইয়ে-দুইয়ে চার হিসাব মিলিয়ে বলছেন, আমাজনের আগুন একেবারেই প্রাকৃতিক বা কাকতালীয় নয়।

এবার আগুন লাগতে শুরু করার বহু আগে সেই এপ্রিল-মে মাসেই পরিবেশবাদীরা ‘বোলসোনারোরর নির্বনায়ন’ বা ‘বোলসোনারোস ডিফরেস্টেশন’ নামে একটি নতুন প্রত্যয় চালু করেন। কারণ, বোলসোনারো জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমাজনের রেইনফরেস্ট নিয়ে ভাবালুতার কিছু নেই। বোলসোনারোর বক্তব্য ট্রাম্পের মতোই। বিশ্বের মানুষের ভালোমন্দের দেখাশোনা সারা বিশ্বের সব দেশেরই কর্তব্য, তাঁর একার নয়। তাঁর বক্তব্য, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার মানে বাণিজ্যিক ও অর্থকরী কাজে লাগানো। আশঙ্কার শুরুও তখনই। ইন্তেলিজেন্সার নামে একটি পত্রিকা এমনকি বোলসোনারোর নির্বাচিত হয়ে আসার আগেই একটি চমকপ্রদ প্রতিবেদন করেছে তাঁর পরিবেশবিরোধিতা নিয়ে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘ক্যুড ওয়ান ম্যান সিঙ্গেল-হ্যান্ডেডলি রুইন দ্য প্ল্যানেট?’ বা ‘একজন একক হাতেই কি এই গ্রহকে বিনাশ করে দিতে পারে?’। বোলসোনারো নির্বাচিত হয়ে এলেন। ইন্তেলিজেন্সারের প্রতিবেদনটিই সত্য হতে চলল কি না, এই আশঙ্কা লতায়-পাতায় বাড়ছেই।

বড় পুঁজির করপোরেশনগুলো মুনাফার স্তূপের পর স্তূপ গড়তে গড়তে প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন দেখাবে। কিন্তু ভুগবে আমাজনের আদিবাসীরা, সারা বিশ্বের মানুষ। দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংঘগুলোকে যথেষ্ট তৎপর দেখা গেল না। কেন গেল না, সে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সব সুচিন্তার মানুষেরই কথা বলা প্রয়োজন। আমাজন আমাদের সামষ্টিক দায়, আমাদের সবার সম্পদ, ব্রাজিলের একার কিছু নয়।

পৃথিবীর যেখানেই উগ্র ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী নিরোরা রাষ্ট্রচূড়ায় চড়বে, পৃথিবী বাসযোগ্যতা হারাতে থাকবে, পরিবেশ ও প্রাণিজগৎ বিপন্ন হতে থাকবে। আমাদের সন্তানদের জন্য আবাসযোগ্য পৃথিবী চাইতে হলে পরিবেশ নিয়ে যেমন বলে যেতেই হবে, রাজনীতির নিরোদের প্রতিও ঘৃণা জানিয়ে যেতে হবে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।