হেফাজতের 'শক্তি' ও সরকারের অসহায়ত্ব

১ আগস্ট মহিলা পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘যাদের পেছনে বেশি রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে, সরকার তাদের কথা আমলে নিতে বাধ্য। সরকার এখন যা করছে, তা কৌশলগত এবং দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে এ গোষ্ঠী পরাজিত হবে।’ (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ২০১৯)

ওই আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবিক পাঠ্যসূচি চাই’। সভায় উত্থাপিত মূল প্রবন্ধে বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মাদ্রাসার পাঠ্যসূচির পরিবর্তন এবং কওমি শিক্ষা আধুনিকায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। আলোচনা সভায় যেসব শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা কেউ সরকারের বিরোধী নন, বরং কমবেশি আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। প্রবন্ধকারের পাশাপাশি তাঁরাও পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া রচনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। ধারণা করি, উপমন্ত্রী এসব দাবি ও সুপারিশের জবাবে এ কথাগুলো বলেছেন।

হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালে যখন সরকার প্রগতিশীল লেখক-কবিদের রচনাগুলো বাদ দিয়েছিল, তখন মহিবুল হাসান চৌধুরী উপমন্ত্রী ছিলেন না। তারপরও তিনি সেই সিদ্ধান্তের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে বললেন, ‘তত্ত্বগত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়, সেই পরিস্থিতিটা আমরা এনে দিতে পারছি না। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারছে। তারা তো বলতে পারছে আমার তো রাজনৈতিক (ক্যাপিটাল) শক্তি অনেক বেশি। নারীরা যখন বলবে আমার রাজনৈতিক (ক্যাপিটাল) শক্তি আরও বেশি, আমরা এগুলো চাই, তখন আমরা শুনতে বাধ্য হব।’

এর মাধ্যমে উপমন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁর ভাষায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী’ সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যাদের দাবি আওয়ামী লীগ সরকারকে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু সেই ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি’ কিসের জোরে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তা তিনি বলেননি।

তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করার আগে হেফাজতে ইসলামের ইতিহাসটা জানা দরকার। ১৩ দফা দাবি নিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম গঠন করে। হাটহাজারীর কওমি মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে এর সভাপতি করা হয়। একই বছর আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করলে হেফাজত তার বিরোধিতা করে। এরপর ২০১১ সালে সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলে একে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। আন্দোলনের নামে ২০১৩ সালের ৫ মে তারা ঢাকা শহরে কী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা-ও নিশ্চয়ই শিক্ষা উপমন্ত্রীর অজানা নয়। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, বিএনপির মদদে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে হেফাজত ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালিয়েছে। সরকার তখন হেফাজতের মহাসমাবেশে ভীত না হয়ে কঠোর হাতে সেই তাণ্ডব দমনও করেছে। কিন্তু তারপর কী ঘটল? দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল, বিএনপির মদদপুষ্ট হেফাজত হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের মদদ পেতে থাকল এবং এখনো পাচ্ছে।

যেকোনো দেশের ভাবাদর্শ বোঝার একটা বড় মাপকাঠি হলো পাঠ্যবই। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অধিপতিরা দেশটিকে কোন আদর্শে গড়ে তুলতে চান, পাঠ্যবইয়ে তার একটা প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। ভারতে দীর্ঘদিন কংগ্রেস সরকার ছিল। এরপর অ-কংগ্রেস সরকার এসেছে। কিন্তু কোনো সরকার পাঠ্যবইয়ে তেমন পরিবর্তন আনেনি। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার এসে পাঠ্যবই আমূল বদলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। বিরোধীরা এর নাম দিয়েছেন, ‘গেরুয়া বা হিন্দুত্ববাদের শিক্ষা’।

আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামী লীগ সরকার যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে, তাকে কোনোভাবেই সময়োপযোগী, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না। বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরেরা কী পড়বে কী পড়বে না, সেটি এখন ঠিক করে দিচ্ছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তারা মাদ্রাসাশিক্ষা নিয়ে তাদের দাবি সীমিত রাখেনি; সাধারণ শিক্ষার বিষয়েও খবরদারি করছে। শিক্ষা দপ্তরের উপমন্ত্রী হেফাজতকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছেন। তিনি হেফাজতের বিপরীতে নারীসমাজকে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করার কথা বলেছেন। কিন্তু এই মতাদর্শগত লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ কী ভূমিকা নেবে, তা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।

হেফাজতের সুপারিশে পাঠ্যবই থেকে যেসব কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে হুমায়ুন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সানাউল হকের ‘সভা’, জসীমউদ্‌দীনের ‘দেশ’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, বাউল লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘খতিয়ান’। গদ্যরচনার মধ্যে আছে সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ কাহিনী’।

আমরা ওই বাদ দেওয়া লেখাগুলো পড়ে দেখেছি, এর একটিতেও ইসলাম ধর্মবিরোধী কিছু নেই। তারপরও সেগুলো বাদ দেওয়ার পক্ষে হেফাজতের যুক্তি হলো, এর লেখকদের বেশির ভাগ হিন্দুধর্মাবলম্বী। আর তাঁদের মধ্যে যাঁরা মুসলমান লেখক আছেন, তাদের কাছে তাঁরাও অগ্রহণযোগ্য। যাঁরা পাঠ্যবই থেকে হিন্দু লেখকদের রচনা বাদ দেওয়ার দাবি আদায় করেছেন, তাঁদের জানার কথা যে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল–কোরআন বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছিলেন ভাই গিরীশচন্দ্র সেন। তিনি মুসলমান নন, একজন হিন্দু। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদীর পাঁচদোনায়।

কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি এভাবে পাঠ্যবই অদলবদল হতে পারে? ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যেসব শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সরকরের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার কী কারণে সরকার তাঁদের দাবি উপেক্ষা করেছে এবং হেফাজতের দাবি আমলে নিয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে।

এত দিন আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় নিয়ে গেছে। কিন্তু টানা সাড়ে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ সেই বিপরীত ধারা থেকে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিয়ে আসতে যে মোটেই সচেষ্ট নয়, তার প্রমাণ পাঠ্যবইয়ের অদলবদল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে দায়ী করে। আবার জাতীয় পার্টিকেই তারা কখনো সরকারের শরিক, কখনো অনুগত বিরোধী দল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই স্ববিরোধিতা দিয়ে আর যা-ই হোক, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তাদের ২৫৭টি আসন (সংরক্ষিত আসন বাদে) আছে, আওয়ামী লীগের সমর্থক এত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এত সংবাদপত্র ও টেলিভিশন আছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শাখা তথা প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাও চলে আওয়ামী লীগ সরকারের কথায়। অন্যদিকে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এরপরও যদি উপমন্ত্রীর ভাষায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির’ রাজনৈতিক ক্যাপিটাল (পুঁজি) আওয়ামী লীগের চেয়ে শক্তিশালী হয়, তাহলে শুধু শিক্ষা নয়, এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। ‘রাজনৈতিক শক্তির’ জোরে হেফাজতে ইসলাম আজ পাঠ্যবই অদলবদল করিয়েছে, কাল সংবিধান পরিবর্তন করাবে, পরশু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরানোর দাবি তুলবে (তাদের দাবির মুখে ইতিমধ্যে সরকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিয়েছে)।

মহিবুল হাসান চৌধুরী যা বলেছেন, তাতে শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অরাজনৈতিক হেফাজতে ইসলামকে একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু হেফাজতের বিপরীতে যেসব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আছে, তাদের প্রতি সরকারের আচরণ শুধু বৈরী নয়, কখনো কখনো নির্যাতনমূলকও, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে তারা জনগণের স্বার্থে রাজপথে কোনো কর্মসূচি নিলে সেটি কঠোর হাতে দমন করা হয়। ২০১৩ সালে বিএনপির বি টিম হিসেবে কাজ করা হেফাজত আজ কীভাবে আওয়ামী লীগের বি টিম হলো, সেটাও গবেষণার বিষয়।

পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে দিয়ে যা করাতে পারেনি, সেটাই হেফাজত আওয়ামী লীগকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। উপমন্ত্রী মহোদয় ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ বদলের জন্য হেফাজতের বিপরীতে বড় রাজনৈতিক শক্তির আবাহন প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু সরকার যদি ক্রমাগত হেফাজতের মতো সংগঠনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে, তাহলে সেই রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কখনোই ঘটবে না। নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যাদের দেখা যেত, তাদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। নৈকট্য বেড়েছে হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের সঙ্গে।

আওয়ামী লীগের নেতারা অহরহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও কাজ করেন ঠিক তার উল্টো। হেফাজতের কথায় পাঠ্যবইয়ের অদলবদল তার অসংখ্য উদাহরণের একটিমাত্র।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]