শিশুদের বাঁচতে দিন

এক যে আছে দেশ। সেই দেশে বাস করে অনেক অনেক শিশু। শিশু মানেই পবিত্র, শিশু মানেই সুন্দর আর শৈশব মানেই স্বর্গীয়। তাই অনেক শিশুর বাসভূমি স্বর্গভূমি হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্য! সেই দেশে এই নিয়ম খাটে না। সে দেশের শিশুরা হাসতে পারে না কী এক অজানা আশঙ্কায়! তারা সব সময় ভয়ে গুটিয়ে থাকে। তারা ভয় পায় বাড়ির বাইরে যেতে। স্কুলে, খেলার মাঠে, রাস্তায়, আত্মীয়স্বজনের বাসায়, গানের স্কুলে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে—কোথাও নিশ্চিন্ত সময় কাটাতে পারে না তারা। এমনকি ঘরের ভেতরেও শান্তি নেই তাদের। ছেলেমেয়েদের চিন্তায় নিশ্চিন্ত ঘুমাতে পারেন না তাদের মা-বাবা। সে দেশের সুখপাখিরা তাই ঠিক করেছে, সবাই মিলে উড়ে যাবে অন্য কোথাও। শিশুদের এত কষ্ট তারা আর সইতে পারে না।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই দেশে প্রায় প্রতিটি শিশুর কাঁধে ব্যথা। তাদের মেরুদণ্ডের অবস্থাও ভালো না। কারণ, সেই দেশে প্রতিটি শিশুকে বয়ে বেড়াতে হয় বিশাল বিশাল বইয়ের বোঝা। বইয়ের বোঝা তবু চোখে দেখা যায়। কিন্তু ছোট ছোট শিশুর বুকের মধ্যে জমে ওঠা কষ্টের বোঝা কেউ অনুভব করে না। তাদের কষ্টের বোঝা কমিয়ে দেবে, এমন কেউ নেই সেই দেশে। সেখানে শুধুই চলে প্রতিশ্রুতির বন্যা। তাদের রঙিন স্বপ্নগুলো পাখা মেলে না; স্বপ্নগুলো কেবলই বিবর্ণ হতে থাকে পরীক্ষায় শুধুই ভালো ফল করার প্রত্যাশার চাপে। সেই দেশের শিশুরা গান গাইতে ভালোবাসে, ভালোবাসে নাচ করতে, ছবি আঁকতে, আবৃত্তি করতে। কিন্তু সেসবের চর্চাও তারা ভালোবেসে করতে পারে না। সেখানেও সব সময় প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা স্টার, সুপারস্টার হওয়ার দৌড় তাদের সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়।

সে দেশে প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় শিশু বয়সে। বিয়ের কিছুদিন পরই শিশুবধূটির কোলে দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে আরেকটি শিশু। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নানান আইনকানুন আছে সেই দেশে। নেই শুধু সেসব আইনের সঠিক বাস্তবায়ন। সে দেশে প্রতিবছর হাজারখানেক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পর্দার আড়ালে থেকে যায় নির্যাতনের শিকার আরও কত শত শিশুর কান্না। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চেনার আগেই শিশুর কোমল শরীরের ওপর হামলে পড়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার দল। এমনকি সেই দেশে শিশুরা নিরাপদ নয় তাদের আপনজন কিংবা শিক্ষকদের কাছেও। শিশুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের শরীর রক্তাক্ত হয়। শিশু নির্যাতকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বিচার হয় না। আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে অপরাধীরা। আবার নতুন নতুন অপরাধের প্লট খুঁজতে থাকে। সে দেশে নির্ভয়ে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করতে পারে না সদ্য শৈশব পেরোনো কিশোরী মেয়েটি। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে রোজ তাদের পিছু নেয় বখাটে ছেলের দল। কিন্তু সমাজ ওই বখাটে ছেলেদের কেউ কিছু বলে না। উল্টো আক্রান্ত মেয়েটির দিকে আঙুল তোলা হয়, যেন সব অপরাধ তাদেরই। প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায় মেয়েটির স্কুলে যাওয়া। তবে ছেলেশিশুরাও নিরাপদ নয় সেই দেশে।

সে দেশে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই, নেই বিনোদনকেন্দ্র, নেই সাঁতার শেখার জায়গা। আছে শুধু ব্যাঙের ছাতার মতো রাশি রাশি কোচিং সেন্টার। কোনো নির্দেশেই বন্ধ করা যায় না সেই সব কোচিং সেন্টার। স্কুলের পাশাপাশি এই সব কোচিং সেন্টার শিশুর শৈশবকে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। সেই দেশে রাস্তায় কিংবা গণপরিবহনে মা-বাবার হাত থেকে কোনো শিশু একবার ফসকে গেলে তাকে আর কখনো ফেরত পাওয়া যায় না। সেই দেশে সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্যের প্রতিবাদে আর সহপাঠী হারানোর বেদনায় অন্য কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে শিশুরা নিজেরাই রাস্তায় নেমে আসে। তারপর শিশুদের ঘরে ফেরাতে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা কখনো বাস্তবায়িত হয় না। এমনকি সেই দেশে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে মাকে ছেলেধরা মনে করে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। মৃত মায়ের পথ চেয়ে থাকে শিশুসন্তান; কখন আসবেন মা আর মুখে তুলে দেবেন খাবার! কিন্তু শিশুটির মা আর কখনো ফিরে আসেন না।

সে দেশে শিশুরা নিশ্চিন্তে খেতে পারে না। তারা যা খায়, তাতেই ভেজাল। সে দেশে শিশুখাদ্যেও নিষ্ঠুরভাবে মেশানো হয়ÿ ক্ষতিকর উপাদান। মেলামিন, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট, সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক—কী নেই সে দেশের খাবারে! শিশুর মা-বাবা বিভ্রান্ত হয়ে খুঁজতে থাকেন ভেজালমুক্ত খাবার। কিন্তু দেখা মেলে না সে খাঁটি খাদ্যসামগ্রীর। সে দেশে শিশুদের জন্য আইন আছে, আছে মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর আরও কত–কী! নেই শুধু শিশু সুরক্ষা আর শিশুর প্রতি অন্যায়কারীর দ্রুত ও আইনানুগ শাস্তি।

সুখপাখিরা তো উড়ে যাবেই। ভয় হয়, হয়তো অচিরেই কোনো একদিন সে দেশে হাজির হবে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা। তার বিষাদের জাদুকরি সুরে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে সে দেশের শিশুরা আর তাদের অভিশপ্ত শৈশব। আর অন্তঃসারশূন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎকে চকচকে র‍্যাপিংয়ে মুড়িয়ে সুখের সন্ধান জানাবেন সে দেশ পরিচালনাকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। সেই দেশের শিশুরা বাঁচতে চায়, হাসতে চায়, নিরাপদ জীবন পেতে চায়। তারা ছুটে যেতে চায় প্রকৃতির কাছে, ফুলের কাছে, পাখির কাছে। তারা প্রজাপতির রঙিন পাখার পরাগ মেখে উড়ে বেড়াতে চায়। কেউ কি ওদের বাঁচাতে পারেন? দয়া করে ওদের বাঁচতে দিন।

নিশাত সুলতানা : লেখক ও গবেষক
[email protected]