আমাজন, সুন্দরবন, জাহাঙ্গীরনগর

অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা। প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ননীতির এক কালপর্ব অতিক্রম করছি। আবার টেকসই উন্নয়নের কথা বলে গলাও ফাটাচ্ছি। প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষার কথা বলছি। সবকিছু মিলেমিশে একাকার। এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে চায় না। কিন্তু প্রকৃতি-পরিবেশ ভালো অবস্থায় নেই। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন থেকে বাড়ির পাশের সৃজিত বন, কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না আগ্রাসী উন্নয়ননীতির কারণে। তাই পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন পুড়ছে। সুন্দরবনের পাশেই শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গাছ উপড়ে নির্মিত হচ্ছে আবাসিক হল।

খটকা লাগতে পারে, আমাজন, সুন্দরবন বা জাবি এক হয় কী করে। এই তিন উদাহরণের অবস্থান ও ব্যাপ্তি ভিন্ন। কিন্তু সমস্যা ও চরিত্র এক। তিনটি জায়গাতেই যা হচ্ছে, সব উন্নয়নের নামেই হচ্ছে।

আমাজনে অনেক দিন ধরেই বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর নজর। বলা হচ্ছে, আমাজনের নিচে খনিজ সম্পদের বিশাল ভান্ডার লুকিয়ে আছে। এসব উত্তোলন করলেই ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অভাব উধাও হয়ে যাবে। সবকিছু ইউরোপ-আমেরিকার মতো ঝকঝকে-তকতকে হয়ে যাবে। রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে দেশে আর লোডশেডিং নামক কিছু থাকবে না। জাবিতে শত শত গাছ কেটে সেই জায়গায় নির্মাণ করা হবে আবাসিক হল। আসলে এখনো প্রকৃতির জন্য বৃক্ষ এবং ছাত্রছাত্রীদের আবাসন মুখ্য না, আসল হলো এই নির্মাণযজ্ঞের বরাদ্দ করা কোটি কোটি টাকা। পরিণামে গাছও যাবে, উন্নয়নের নামে দুর্নীতি হবে। ইতিমধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা পরিবেশবিনাশী দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংবাদ-সম্মেলন করেছেন।

উন্নয়ন অবশই দরকার। কিন্তু প্রকৃতিকে বিনাশ করে কেন? প্রকৃতি তো বিলাস নয়; জীবনের প্রধানতম শর্ত। এক দশকের ভয়াবহ আগুনে তিন সপ্তাহ ধরেই পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত আমাজনের ব্রাজিল অংশের বিভিন্ন স্থান জ্বলছে। ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জায়ার বোলসোনারো এনজিওদের দায়ী করেছেন অগ্নিকাণ্ডের জন্য। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বোলসোনারো ইচ্ছা করেই আগুন নিভাচ্ছেন না। কমবেশি তিন হাজার জায়গায় আগুন জ্বলছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনের অভিযোগ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দিকে। এই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বোলসোনারো। তিনি আমাজনকে পুড়িয়ে ব্রাজিলকে উন্নত করতে চান। আমাজনে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ আনতে চান।

বাংলাদেশ, ব্রাজিল—সবাই দেশকে উন্নত করতে চায়। কিন্তু এই উন্নয়নের চাহিদায় আমাজন, সুন্দরবন হুমকির মুখে। দিনকে দিন শঙ্কা বাড়ছে। গত অর্ধশতকে আমাজনের আয়তন কমেছে ১৭ শতাংশ। এই অবস্থায় আমাজনে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড সন্দেহের উদ্রেক করছে। রাষ্ট্র, পরিবেশবাদী কোনো পক্ষকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। আমাজনে কে আগুন দিয়েছে বা এটা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দাবানল কি না, এ নিয়ে বিতর্ক হবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো নিশ্চিতও হওয়া যাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যাবে।

বাস্তবতা হলো বন, জঙ্গল, পরিবেশ নিয়ে জটিল রাজনীতি হচ্ছে। আমাজনে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বা বন রক্ষার অর্থায়ন—দুটোই আসে উন্নত বিশ্ব থেকে। ওরাই সব দেয়। একদিকে উন্নত হওয়ার তাগাদা দিয়ে প্রকৃতিকে বিনাশ করতে উৎসাহ দেবে, অন্যদিকে প্রকৃতিকে রক্ষায় গুরুত্বারোপ করবে। মুনাফানির্ভর এই উন্নয়নের জটিল রাজনীতি থেকে যদি দক্ষিণের দেশগুলো বের হয়ে না আসতে পারে, তবে আজীবন শোষিতই থেকে যাবে। বন ও প্রকৃতি উজাড় হতেই থাকবে। শেষাবধি উন্নয়নের চীনা মডেলে পরিণত হবে। চীনের দূষণ এখন এতটাই ভয়াবহ যে এই উন্নয়নকে হলুদ উন্নয়ন বলা হয়। বেইজিং এখন ঢাকা থাকে স্মগের (ধোঁয়ার কুয়াশা) আড়ালে।

চীনের ঘটনা প্রমাণ করে যে মুনাফাতন্ত্র প্রকৃতিকে উন্নয়নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের পরও আমাদের হুঁশ ফিরছে না। মুনাফাভিত্তিক মনোভাবের কারণে বনজঙ্গল সাফ করে এক দূষিত উন্নয়নের পেছনে দৌড়াচ্ছে সবাই। পপুলিস্ট রাজনীতিতে আমেরিকা ও ব্রাজিলের মতো সরাসরি ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে আসীন হওয়া ব্যক্তিরা যাকে উন্নয়ন বলছেন, তা যে আসলে একটা বিশেষ শ্রেণির সম্পদ লুণ্ঠনের কৌশল, তা বুঝতে জনতাও দেরি করছে। যখন বুঝবে, তখন হয়তো আর কিছু করার থাকবে না।

আমাদের অবশ্যই উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বর্তমানে যে উন্নয়ননীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা আমাদের উন্নত না করে, বরং নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন। শিল্পবিপ্লব সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। আবার জলবায়ুর পরিবর্তন নানাবিধ রোগশোকের মধ্যেও ঠেলে দিয়েছে। আমাদের বিদ্যুতের দরকার আছে। আবার সুন্দরবনেরও দরকার আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিকল্প স্থান আছে, কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।

বিভিন্ন প্রয়োজনের মধ্যে যদি সমন্বয় না করা যায়, তবে এই উন্নয়ন মানববান্ধব হবে না, পুঁজিবান্ধব হবে। এবং এই উন্নয়ন থেকে আমাদের কোনো উন্নতি হবে না। তথাকথিত উন্নত বিশ্বেরই লাভ হবে। কারণ, সুন্দরবন ধ্বংস করে যে উন্নয়ন হবে, সেই উন্নয়নের ঠেলা সামলাতে আবার উন্নত বিশ্বেরই দ্বারস্থ হতে হবে।

কিন্তু এতে কেবল প্রকৃতিই ধ্বংস হচ্ছে না। মানুষ নিজের ধ্বংসের পথও তৈরি করছে। মানুষ ও প্রকৃতির অখণ্ড সত্তার ওপর আঘাত হানছে কাঠামোভিত্তিক চিন্তা। এ কারণে দূষণ ও ধ্বংস বাড়ছে। অমানবিকীকরণের প্রক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে মানুষের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাজন বা সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানে পুনরুৎপাদনের কোনো সুযোগ থাকবে না। এটা চিন্তার কাঠামোগত সমস্যা। কিন্তু এই কাঠামোগত চিন্তা থেকে বের হয়ে চিন্তার পথকে খুলে দিতে হবে। পুঁজিতন্ত্রকে খারিজ না করে অতিক্রম করতে হবে। তবেই প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ একযোগে রক্ষা পাবে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন