সার্কের মৃত্যুতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি

কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ১৮তম সার্ক সম্মেলনের এমন দৃশ্য কি আর শিগগির জন্ম নেবে? বক্তৃতা দিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (বাঁয়ে), মঞ্চে (মাঝে) উপবিষ্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এএফপি
কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ১৮তম সার্ক সম্মেলনের এমন দৃশ্য কি আর শিগগির জন্ম নেবে? বক্তৃতা দিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (বাঁয়ে), মঞ্চে (মাঝে) উপবিষ্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এএফপি

নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার শপথ নিয়েছিলেন ২০১৪ সালের ২৬ মে। দ্বিতীয় দফা শপথ নিলেন এ বছরের ৩০ মে। ওই দুই শপথ অনুষ্ঠানের মধ্যে এমন অনেক কিছুই ছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে একটি হলো ২০১৪ সালের শপথ অনুষ্ঠানে সাড়ম্বরে ঘোষণা দিয়ে ‘সার্ক নেতৃবৃন্দ’কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দ্বিতীয় শপথে সার্ককে বাদ রেখে দাওয়াত দেওয়া হলো ‘বিমসটেক’ নেতৃত্বকে। সেটাও ঘোষণা দিয়ে।

আপাতদৃষ্টিতে জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে ভারত কাদের দাওয়াত দেবে, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আরও সঠিকভাবে বললে এটা ভারতীয় জনতা পার্টির বিদেশনীতিরই প্রকাশ। কিন্তু উপমহাদেশের বড় শক্তি হিসেবে ভারতের সব কূটনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছাই তাৎপর্যবহ। মোদির দুই শপথানুষ্ঠানের অতিথি তালিকাও তাই আঞ্চলিক কূটনীতিবিদদের নজর এড়ায়নি। ভারতের দিক থেকে এতে বড় এক বার্তা ছিল। দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার তিন দশক পুরোনো সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে সার্ককে আর জীবিত ও সচল দেখতে চাইছে না। কিন্তু সার্কের অপমৃত্যুর কুফল পুরো অঞ্চলে টের পাওয়া যাচ্ছে এ মুহূর্তে; বিশেষত কাশ্মীরে উত্তেজনার পর।

এবার লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে বলা ছিল, বিমসটেককে নিয়েই এগোবে ভারত। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে সার্কের যে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, তাও ভারত সরকারের বিরোধিতায় হয়নি। ফলে, মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সার্ক আমন্ত্রিত না হওয়া আকস্মিক কোনো ঘটনাও নয়। কিন্তু মুশকিল হলো সার্ক ও পাকিস্তানকে একাকার করে ফেলেছে ভারত। মূলত, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বিরোধের ক্রসফায়ারে পড়ে সার্ক মৃত্যুপথযাত্রী। পাঁচ বছর হলো এই জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের একসঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। আপাতত সেই সম্ভাবনাও নেই। অথচ ইতিহাসে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একসঙ্গে বসার জরুরত এখনই বেশি।

সার্ক থেকে বিমসটেক: কার স্বার্থে
সার্কের সঙ্গে বিমসটেকের গঠনগত পার্থক্য হলো প্রথম জোটের আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান দ্বিতীয় জোটে নেই। আবার দ্বিতীয় জোটের মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড প্রথম জোটে নেই।

গঠনগত এই ভিন্নতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত চাইছে সার্কের মৃতদেহের ওপর বিমসটেক সক্রিয় হয়ে উঠুক। কারণ, মোদি প্রথম দফায় ক্ষমতা এসে সার্কভুক্ত দেশগুলোয় গাড়ি চলাচলের যে প্রস্তাব দেন, পাকিস্তান তাতে শীতল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সার্ক স্যাটেলাইট বিষয়েও তাদের আগ্রহ ছিল কম। একই সময়ে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডর গড়তে শুরু করে। ভারত এই পরিস্থিতির উত্তর দেয় ১৯তম সার্ক সম্মেলন বন্ধ করিয়ে, যা ২০১৬ সালেরর নভেম্বরে পাকিস্তানে হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানকে সার্কের চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে অনিচ্ছুক ভারত, যার জন্য তারা বিমসটেককে পুনরুজ্জীবিত করে।

প্রকাশ্যে অবশ্য নয়াদিল্লি বলছে, সার্ক জোট হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে একদম সফল ছিল না। প্রায় তিন দশক একসঙ্গে পথচলার পরও সদস্যদেশগুলো পারস্পরিক অর্থনীতির ১০ ভাগও সমন্বিত করতে পারেনি। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেও সেটা করা যায়নি। বিমসটেক দিয়ে ভারত সেটাই করতে চায়। কিন্তু সার্কের যেকোনো ব্যর্থতার দায় যে বড় সদস্যদেশের ঘাড়েই বর্তায়, সেটা ভারতীয় কূটনীতিবিদেরা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক।

বিমসটেকে কেন আগ্রহ ভারতের?
বিমসটেক বলতে বোঝানো হচ্ছে Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation। ভুটান ও নেপাল মোটেই বঙ্গোপসাগর–লাগোয়া দেশ নয়। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে তাদের কোনো কাজকারবারই নেই। মূলত, ভারতের চাপে বা অনুরোধেই যে তারা এই জোটভুক্ত হয়েছে, সেটা অনুমান করা যায়।

সার্ককে নিষ্ক্রিয় করে বিমসটেককে শক্তি জুগিয়ে ভারত মূলত দুটি লক্ষ্য হাসিল করতে চাইছে। প্রথমত, আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে একঘরে করা—সার্কে থাকলেও বিমসটেকে তাদের নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, সার্ক ফোরামে নদীর পানি থেকে সীমান্ত বিরোধ পর্যন্ত আঞ্চলিক প্রায় সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনার যে পরিসর ছিল তা বন্ধ করা। ভারতের সঙ্গে পানির হিস্যা ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্থাপনের বিষয়ে যৌক্তিক আঞ্চলিক নীতিকৌশলের পক্ষে প্রকাশ্যে বলা যেত সার্কে।

কিন্তু বিমসটেককে ভারত গড়ে তুলতে চায় কেবল বাণিজ্যিক জোট হিসেবে। সেখানে পাকিস্তান না থাকায় কোনো বিষয়ে ভারতের অবস্থানের বিরোধিতার মতো দেশও থাকছে না। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় চীনের উদীয়মান আধিপত্য মোকাবিলাতেও তার নেতৃত্বাধীন বিমসটেক কাজে লাগবে বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। তবে এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো ভারত ও ভুটান ছাড়া বিমসটেকের অপর পাঁচটি দেশ ইতিমধ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরই) যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সার্ক বাঁচাতে লড়ছে কেবল নেপাল
সার্কের শুকিয়ে মরা বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। বিশ্বে ঢাকার বড় কূটনৈতিক সফলতার স্মারক ছিল সার্ক। বাংলাদেশই এই জোটধারণার প্রস্তাবক। এর প্রতিষ্ঠায় প্রচুর খেটেছেও বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে ঢাকাতেই এর যাত্রা।

নেপালের জন্যও সার্কের অপমৃত্যু বেদনাদায়ক। কাঠমান্ডুতে রয়েছে এই জোটের সচিবালয়। জোটের বর্তমান চেয়ারম্যানও তারা। তবে ভারত যখন সার্ককে ক্রমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে, বাংলাদেশ তাতে জোরালো কোনো আপত্তি তোলেনি। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কূটনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থানবদল। তবে নেপালের নেতৃবৃন্দ প্রায়ই সার্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন; বিশেষত নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তবে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নতুন অবস্থানের পর নেপালও সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকখানি হতাশ।

সার্ক হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ ভোলাতেই হয়তোবা বিমসটেকের সচিবালয় ঢাকায় রাখার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু বিমসটেকভুক্ত একটি দেশ কর্তৃক প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের সুরাহা করতে না পারা এই জোটের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভারত ব্যতীত অন্য দেশগুলোর জন্য এই জোট কী উপকারে আসবে, সেটা স্পষ্ট নয়।

অতীতে সার্ক যেমন কাশ্মীর কিংবা আন্তনদীগুলোর পানির হিস্যার মতো আঞ্চলিক জরুরি বিবাদে কোনো ভূমিকা রাখতে না পেরে ক্রমে সাধারণ মানুষদের উদাসীনতার কারণ হয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গা বিবাদের কোনো মীমাংসা করতে না পারলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারও বিমসটেকভুক্ত হয়ে কাছাকাছি আসতে পারবে না। বাংলাদেশের তরফ থেকে বিমসটেকের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ইতিবাচক মনোভাবের ওপর। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার শুরুতেই ভারতের সমর্থন যায় মিয়ানমারের দিকে। বিমসটেক এ ক্ষেত্রে ঢাকার পক্ষে কোনো ভূমিকা দেখাতে পারেনি।

সার্কের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তায় আরেক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান। বহু আবেদন-নিবেদন শেষে সাত সদস্যের সার্কে তারা যুক্ত হতে পেরেছিল ২০০৭ সালে। আবার বিমসটেকেও তারা নেই। ফলে, আঞ্চলিকভাবে তাদের এখন সব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে দর-কষাকষি করতে হচ্ছে। আঞ্চলিক কূটনীতিতে তাদের উপস্থিতিও সীমিত হয়ে পড়েছে। তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচুক্তি হয়ে গেলে ভারত আর আফগানিস্তানকে বিমসটেকে নেবে বলেও মনে হয় না।

এ রকম পরিস্থিতিতে একমাত্র আশার দিক সার্ক সেক্রেটারিয়েটের সচলতা। সম্মেলন ও সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সভা-সমাবেশ না হলেও কাঠমান্ডুতে সার্ক সচিবালয় কিছু কাজ করে যাচ্ছে। এই সচিবালয়ের আয়োজনে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে কিছু কিছু অনুষ্ঠান হয় নিয়মিত।

তবে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কূটনীতিক ও সামরিক উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। এর ফল হিসেবে ভারত যদি সার্ক সচিবালয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে, সেটা হতে পারে সার্কের মৃত্যুঘোষণার সামিল। পাকিস্তানি কূটনীতিবিদ আমজাদ হোসেন বর্তমানে এই দপ্তরের প্রধান। এই পদে একজন পাকিস্তানির দায়িত্ব পালন ভারতের কাছে যেকোনো সময় বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। ভারত ছাড়া বাকি সাতটি দেশ চাইলে এই সচিবালয় টিকিয়ে রাখতে পারবে বটে; কিন্তু ভারত যখন চলে যেতে চাইবে, তখন সে নিশ্চিতভাবেই আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশকেও সঙ্গী করতে চাইবে।

সার্ক বনাম বিমসটেক?
সার্কের মৃত্যু ঘটিয়ে বিমসটেককে প্রাণবন্ত করার চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। এর বড় কারণ, বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বন্ধন সামান্যই। অথচ সমধর্মী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ধারণ করত সার্কভুক্ত দেশগুলো।

সাম্প্রতিক বিশ্বের একটা পরিচিত অভিজ্ঞতা হলো কোনো আঞ্চলিক জোটে একটি দেশ অন্যগুলোর চেয়ে আকারে, শক্তিতে, অর্থনীতিতে এবং মনোভাবে অধিক আধিপত্যধর্মী হলে সেই জোটে ভারসাম্য থাকে না। এ রকম হলে জোটকে এগিয়ে নেওয়ায় ছোট সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ থাকে কম। বরং একাধিক সমশক্তির দেশের জোট ভালো কাজ করে। বিমসটেক নিয়ে ভারতের আশাবাদ তাই যতটা স্পষ্ট, অন্য ক্ষুদ্র সদস্যদের উৎসাহ ততটাই অস্পষ্ট। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির অভিমতটি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত। তিনি মনে করেন, বিমসটেক থাকার পরও সার্ক সচল হতে বাধা নেই। কিন্তু ওলির পাশে এ ব্যাপারে পাকিস্তান ছাড়া শক্তভাবে আর কেউ আছে বলে মনে হয় না।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক