আগে মশা সামলান পরে 'ডাইনি' খোঁজেন

ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার সন্ধানে কোথাও চিরুনি, কোথাও কাঁচি, কোথাওবা লাঠি অভিযান চলছে। প্রথম আলো বলছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের মালিকদের জরিমানা করছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ক্ষেত্রবিশেষে কারাদণ্ডও দিয়েছেন আদালত। জুলাই থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ভবনমালিকদের প্রায় ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে সরকারি স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা থাকলেও সেখানে কোনো অভিযান নেই। 

নানা অভিযানের রগরগে খবর দিয়ে এখন মিডিয়াকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে এক মেয়র বিদেশে যাওয়ায় সেখানকার চিরুনিও জিরোতে এসে বসেছে। লোকে কথায় বলে, ‘গেরেস্ত গেল ঘর লাঙল তুলে ধর’। উনি ফিরলে হয়তো আবার তোড়জোড় শুরু হবে। একজন বললেন, মেয়ররা না থাকলে ক্যামেরা থাকে না, ক্যামেরা না থাকলে ওনারা যে কাজ করছেন তা মানুষের মালুম হবে কেমন করে? আর মানুষ না জানলে আমদের কষ্টের মূল্য কে দেবে? খুবই কড়া যুক্তি।

তবে এডিস সন্ধানে ভাটা পড়ুক না–পড়ুক ‘হুইচ হান্টিং’ বা ‘ডাইনি শিকার’ বন্ধ নেই। ডিএসসিসি জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ৫৮ হাজার বাড়িতে তারা অভিযান চালিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেক বাড়িতেই এডিসের মশার লার্ভা পাওয়ায় তা ধ্বংস করে দেওয়াসহ বাড়ির মালিকদের এ বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার প্রথম বড় শিকার ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সংস্থাটিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়ের ওপর দায়িত্ব পড়ে বিষয়টি ব্যাপক প্রচারের। আসুন, দেখুন, যারা উঠতে–বসতে ভালো ভালো কথা বলে, সরকারের ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তাদের আক্কেল দেখুন।

মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে আর সত্য কথা বলার মানুষের ভয় দেখিয়ে চুপ রাখার এ এক সাবেকি কৌশল। আদতে গত তিন বছর যাবৎ সিপিডির নির্মাণাধীন দালানটি ঠিকাদারের হাওলায় আছে। কিন্তু প্রচারটি এমনই মারমুখি ছিল যে সিপিডির কোনো গালতি না থাকলেও তাদের দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের বলতে হয় তারা সিটি করপোরেশনের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা পরের দিন সন্ধ্যায় আবারও ওই ভবন পরিদর্শন করে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন । ইত্যাদি ইত্যাদি।

জুরাইন এলাকায় মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে অবহেলার প্রতিবাদ করার সময় তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়। পরে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে তিনি রেহাই পান। ছবি: প্রথম আলো
জুরাইন এলাকায় মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে অবহেলার প্রতিবাদ করার সময় তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়। পরে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে তিনি রেহাই পান। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার জুরাইনের জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা জনাব মিজানুর রহমান সে এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতার কাজ করে চলেছেন। পাশাপাশি জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের উদাসীনতারও সমালোচনা করে আসছেন। এলাকায় মানববন্ধন, স্থানীয় করপোরেশন অফিসে ধরনা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের এলাকা পরিষ্কার রাখার কাজও তিনি করছেন। কিন্তু ওই যে অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হচ্ছেন, মানুষকে সংগঠিত করছেন, তাই তাঁকে একটু লাল দালান দেখানোর শখ চেপে রাখা যাচ্ছে না। এর আগে ওয়াসার দূষিত পানি নিয়ে সরব হলে ওয়াসার মালিক এ রকম একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জনাব মিজানের অনুমতি না নিয়ে তাঁর বাড়ির মধ্যে ঢুকে ভিডিও করে প্রচার করতে চেয়েছিলেন লোকটা কত নোংরা থাকে আর বড় বড় কথা বলে। বলা বাহুল্য, পাবলিক ওয়াসার সে দস্যুতায় মজেনি। এবার তাঁর বিরুদ্ধে চেতেছে করপোরেশন। ২৫ আগস্ট রোববার মিজানুর রহমানের বাড়িকে টার্গেট করে মশার লার্ভার খোঁজে অভিযান চালায় সিটি করপোরেশনের একটি দল। আগের রাতের বৃষ্টিতে ছাদে জমে থাকা পানির কারণে তাঁকে আটকের চেষ্টাও করা হয়। জুরাইনের সমাজকর্মী মিজানুর রহমানের কপাল ভালো। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একটা চ্যানেল টিভির ক্যামেরাসহ নিবেদিতপ্রাণ ক্রুরা সেখানে ছিলেন। করপোরেশনের পেয়াদা বরকন্দাজরা এতই মত্ত ছিলেন যে পরিচিত চ্যানেল টিভির উপস্থিত কর্মীরা জনাব মিজানকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হেতু জানতে চাইলে তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সিটি করপোরেশনের অঞ্চল পাঁচের নির্বাহী কর্মকর্তা।

আসলে মিজানুর রহমানকে ফটকে আটকে জুরাইন তথা ঢাকাবাসীর মঙ্গলবারের (২৭ আগস্ট) শান্তিপূর্ণ আবস্থান কর্মসূচি বানচালের চেষ্টা ছিল এটা। ডেঙ্গু সমস্যা সমাধানে জুরাইনবাসীর দাবি হতে পারে সকল ঢাকাবাসিরই দাবি:

১. ঢাকাসহ ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতি জেলায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রদান।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ করে সরকারি–বেসরকারি লোকের সমন্বয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিশেষ কমিটি গঠন।
৩. প্রতিটি ইউনিটে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ।
৪. প্রতিটা কমিটিকে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান।
৫. পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সারা বছর এডিস মশা দমনে কার্যক্রম চালানো।
৬. দায়িত্বে অবহেলার জন্য প্রত্যেকের বিচার ও শাস্তি এবং মেয়রসহ কর্তাব্যক্তিদের পদত্যাগ।
৭. ডেঙ্গুতে নিহত, আক্রান্ত পরিবারকে মর্যাদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এসব দাবি নিয়ে আলোচনা হোক, সমাধানের চেষ্টা হোক। যেটাই হোক জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের মতামতকে পাত্তা দিয়েই পথ খুঁজতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]