গাপ্পি, গেঞ্জি-টুপি ও ডেঙ্গু

মানবজাতির অন্যতম প্রধান শত্রু এডিস মশা। শরীরের আকার যা–ই হোক, তার ক্ষমতা হাতি, গন্ডার, বাঘ, ভালুকের চেয়ে বেশি। গত দুই দশকে বাঘ-ভালুক পৃথিবীতে যত মানুষ হত্যা করেছে, এডিস করেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই শত্রু নিধনে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের কারও দায়িত্ব মশা মারার কীটনাশক কেনা। (তাতে যদি কেউ ১০ পারসেন্ট হোক, ১৭ পারসেন্ট হোক কমিশন খায় তো খেতে পারে, কিন্তু ওষুধ যতটা কেনা দরকার, ততটাই কেনে। ১০০ ড্রামের মধ্যে ১০ ড্রাম কিনে পুরো বিল উঠিয়ে নেয় না।) সেসব দেশে মশার ওষুধ ছিটানোর লোকেরা বারো মাস রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, নর্দমায় ওষুধ ছিটান। তারপরও বিভিন্ন দেশে এডিসের কামড়ে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এমনকি জিকায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মরছে। (বাংলাদেশে দেড় মাসে মারা গেছে ১৬৯ জন, আক্রান্ত ৬০ হাজার।) একই সঙ্গে এডিস নির্মূলে সম্ভাব্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কোনো দেশেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হোক, পৌর কর্তৃপক্ষ হোক, কেউই এডিসবিরোধী অভিযানে লাখ-কোটি টাকা গেঞ্জি–টুপি বা ডিজিটাল ব্যানারে ব্যয় করেনি।

এবার বছরের প্রথম দিকে বলা হলো এডিসের আক্রমণে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ধেয়ে আসছে, নগর কর্তাদের কেউ কেউ তা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, এসব সরকারবিরোধী লোকদের রটানো গুজব।

বাংলাদেশে যেকোনো সমস্যা সমাধানের পথ দুটো এবং প্রতিবাদ করার উপায়ও দুটো: মানববন্ধন ও শোভাযাত্রা। মানববন্ধন অপেক্ষাকৃত সহজ। জনাদশেক লোক, একটা ডিজিটাল ব্যানার এবং একটি মাইক হলেই হয়। তবে প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাতে একটু জায়গা খালি পাওয়া কঠিন। শোভাযাত্রা ব্যয়বহুল এবং কিছুটা কষ্টসাধ্য। আটপৌরে পোশাকে বঙ্গীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের রেওয়াজ নেই। স্লোগান লেখা গেঞ্জি ও টুপি অবশ্যই চাই। কোনো কোনো শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থাকে বিয়েবাড়ির মতো ব্যান্ডপার্টি। মশকনিধন প্রচারাভিযানেও তা দেখা গেছে।

হংকংসহ বিভিন্ন দেশে প্রশাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলন হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে এডিসের বিরুদ্ধে অভিযান নয়, শুরু হয়ে গেল আন্দোলন। ওষুধের চেয়ে টুপি–গেঞ্জি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। অভিযানের স্থানে আগেই চলে যায় গেঞ্জি–টুপির বস্তা। পথচারীরা অফিস–আদালত ফেলে দিয়ে গেঞ্জি–টুপির বস্তার চারপাশে দাঁড়িয়ে যান। বিতরণ শুরু হওয়ামাত্র কাড়াকাড়ি। কামড়াকামড়িতে মৃদু আহত হন কেউ কেউ। বস্তা যাঁর জিম্মায়, তাঁর প্রাণনাশ না হলেও জখম হওয়ার জো! কোথাও–বা তাঁর নিজের গেঞ্জিটি পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় আরকি! নারীদের মধ্যে যাঁরা টিভি ক্যামেরার কথা চিন্তা করে দামি শাড়ি-কামিজ-সালোয়ার পরে সাজগোজ করে এসেছিলেন, তাঁদেরও একটি গেঞ্জি চাই। কাড়াকাড়ি করে নিয়ে কেউ সেটা শাড়ির ওপরেই চাপান, কেউ কাঁধের ওপর মেলে রাখেন। পদস্থ কর্মকর্তারা স্যুটের ওপরেই গেঞ্জি পরেন। মাথায় ক্যাপ। শুধু ওগুলো পরেনই না, পরে মন্ত্রী ও সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁদের সামনে অকারণে চক্কর দিতে থাকেন। তিন কুলের কেউ মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছে ছিল না, তিনিও মশার অভিযানে গিয়ে এ কথা–সে কথার মধ্যে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করেন। গেঞ্জি–টুপি কেনা, বিল উত্তোলন ও বিতরণের মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ, তা বাংলার মাটি ছাড়া ভূপৃষ্ঠের অন্য কোনো অংশের মৃত্তিকায় ঘটেনি।

শুধু মানববন্ধন, শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করে বাংলাদেশ বসে থাকার পাত্র নয়। এযাবৎ বিশ্বে যত রকম এডিসবিরোধী তৎপরতা হয়েছে, তার সব কটিই দেড় মাসে এস্তেমালের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এডিস মশা তাড়াতে বাংলার বাউলদের নামানো হয়েছে রাস্তায়। অবশ্য মাটিতে নয়, ট্রাকে। সিটি করপোরেশন ব্যান্ড পার্টি দিয়ে টুপি-গেঞ্জি পরিয়ে বাউল ও গানের শিল্পীদের নামিয়ে দিয়েছে। তাঁদের এডিসবিরোধী গান শুনে সিরাজ সাঁই, লালন সাঁইজি শুধু নন, মশারা পর্যন্ত হেসে কুটিকুটি। যেকোনো কর্মসূচিতে বিত্তবান বাংলাদেশে মানি ইজ নো প্রবলেম। দেড় মাসে ঢাকা দক্ষিণে কোটি কোটি টাকা খরচা হয়েছে।

নতুন আমদানি করা ওষুধে এডিস মশা মরবে কি মরবে না, তা নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও ডেমোনস্ট্রেশন করা হয়েছে নগর ভবনে। মশারি টানিয়ে তার ভেতরে মশা ছেড়ে দিয়ে ওষুধ ছিটানো হয়। দেখা গেল, কিছু মশা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে, কিছু সংজ্ঞা হারিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে, যাদের প্রাণশক্তি বেশি, তারা দিব্যি ভনভন করে উড়ছে।

কর্তৃপক্ষ মসকুইটো স্কোয়াড বানাতে চাইছে। জল্লাদ মশা আমদানি হবে। ‘মশা মারার মশা’ প্রতিটির দাম নাকি ছয় ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে ওটার মূল্য ছয় ডলার না দুই ডলার, সেটা বড় বিষয় নয়, এলএনজি গ্যাসের মতো ওটা ১০ ডলার দিয়ে কিনলেই–বা কে প্রশ্ন তুলছে।

কেনাকাটার ব্যাপার হলে যেকোনো প্রস্তাবই অতি সুখের। মশা ভক্ষণকারী গাপ্পি মাছ আমদানির প্রস্তাব এসেছে। নির্বিচারে ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব কীটপতঙ্গ ও প্রাণী মেরে সাফ করেছি। বাংলার ব্যাঙ বিলুপ্তির পথে। আগের মতো ব্যাঙ থাকলে গাপ্পির দরকার হতো না।

আইয়ুব খান পাকিস্তানি নারীদের লাইগেশন ও পুরুষদের ভ্যাসেকটমি করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিলেন। আমাদের কর্তৃপক্ষ এডিস মশার জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্রতী হয়েছে। পুরুষ এডিস কামড়ায় না, কামড়ায় স্ত্রী এডিস। এডিস মশার রূপান্তর ঘটানো হবে। বংশবিস্তারে বাধা দেওয়া হবে। স্ত্রী এডিসের স্বামীকে নির্বীর্য করা হবে। আমাদের আণবিক শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা স্ত্রী এডিসের পুরুষ সঙ্গীকে বন্ধ্যা করার কাজ করছেন। তবে অনেক স্ত্রী এডিসের যে বয়ফ্রেন্ড থাকবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

যাঁর বাড়িতে এডিস মশা বা তার ডিম পাওয়া যাবে, তাঁকে জেল–জরিমানা করা হবে, আপাতত রিমান্ডে নেওয়া হবে না। তবে জেল–জরিমানা চালু হলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীর বাড়িতেই যে বেশি করে এডিসের আস্তানার খোঁজ পাওয়া যাবে, তাতে সন্দেহ কম।

আমাদের সব ব্যাপারে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। এডিস মশা নির্মূলে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন নেই। নগরবাসীকে নিয়ে নগরী পরিষ্কার রাখলে সমস্যার পনেরো আনা সমাধান সম্ভব। ডেঙ্গু হবে না। হাসপাতাল, ডাক্তার পর্যন্ত যেতে হবে না। উপভোগ্য অভিযান, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন, কীটতত্ত্ববিদ ও আণবিক বিজ্ঞানীদের গবেষণা, গাপ্পি মাছ ও মশা মারা মশা আমদানির প্রয়োজন হবে না। অদক্ষতা, অপচয় ও দুর্নীতি নির্মূল হলে এডিস মশা আপনা–আপনি নির্মূল হয়ে যাবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক