ইনহাউস তদন্ত কমিটি অপরিহার্য

তিন বিচারপতির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির তদন্ত উদ্যোগ বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের একটি নতুন ঘটনা। এর আগে আমাদের জানামতে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য তিন বিচারপতির (বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী, বিচারপতি শাহেদুর রহমান ও বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূঁইয়া) বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে সম্ভবত একটি ক্ষেত্রেই আমরা একটি প্রতিবেদন পেয়েছিলাম। সেখানে অপসারণের সুপারিশ খুব স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু আগের তিনজনের থেকে এবারের তিনজনের (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি জহিরুল হক এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হক) প্রেক্ষাপট আলাদা। বিচারপতি ফয়েজীর জাল সনদের ঘটনায় সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অনুঘটকের। বিচারপতি শাহেদুরের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এনেছিলেন প্রয়াত বিচারপতি নইমুদ্দীনের কন্যা। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরব হয়েছিলেন। বিচারপতি মিজানুরের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণের অভিযোগ উঠেছিল সরকারি দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে। এর মধ্যে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এক বিচারপতি পদত্যাগ করেন। আর কাউন্সিল বিচারপতি মুজিবুরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। আরও একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে সাবেক সেনাশাসক ও বর্তমানে প্রয়াত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে সাবেক বিচারপতি লতিফুর রহমানেরটেলিফোনে কথোপকথনের অভিযোগ ওঠে। ক্যাসেট কেলেঙ্কারিখ্যাত আদালত অবমাননা মামলায় সংবাদপত্রই হাইকোর্টে দোষী সাব্যস্ত হয়, যা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। তবে ওই খবরের পরে এটা প্রমাণিত হয় যে কথোপকথন ঠিকই ঘটেছিল। এখানেও তদন্ত হয়নি। বিচারপতি লতিফুর পদত্যাগ করেছিলেন।

ওপরের ঘটনাবলি থেকে এবারের পর্ব আলাদা। তার কারণ, এটা প্রতীয়মান হয় যে কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির বিষয়ে ইনহাউস তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা বহুবার ‘তোমার পতাকা যারে দাও/ তারে বহিবারে দাও শক্‌তি’—এ কথা স্মরণে এনেছি। কারণ, অভিশংসন বা অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলেই পরিস্থিতির কোনো রাতারাতি পরিবর্তন আশা করা যায় না। আর বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ১৯৭৭ সাল থেকে থাকলেও আমরা অতীতের প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে একটা নিস্পৃহতা লক্ষ করেছি। সেদিক থেকে দৃশ্যত এই প্রথম প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি ইনহাউস তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন।

 আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি এই তদন্তের প্রক্রিয়া কী পদ্ধতিতে শুরু এবং শেষ করেন, সেটা দেখতে আমরা অপেক্ষা করব।আমরা আরও আশা করব যে এই তিন বিচারপতি তদন্তপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় সহযোগিতা দেবেন। এই ঘটনার দুটি দিক। দুজনের ক্ষেত্রে এর আগে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরে খবর বেরোয় যে, তাঁরা অর্থের বিনিময়ে রায় দিয়েছেন। পরে শোনা গেছে, এ রকম একটা পরোক্ষ ইঙ্গিত প্রকাশ পেলেও সরাসরি এই অভিযোগ আপিল বিভাগ করেননি। অন্যজনের অভিযোগের বিষয়ে কোনো প্রকাশিত খবর ছিল না। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানি না কার বিরুদ্ধে কী নির্দিষ্ট অভিযোগ।

তবে তিন বিচারপতির বিষয়ে এমনই স্বচ্ছ ও আইনসম্মত তদন্ত আশা করব, যা একটি অনুসরণীয় উদাহরণ তৈরি করতে পারে। আইন ও বিচারমন্ত্রী এই তিন বিচারপতি পদত্যাগ করতে পারবেন না বলে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার সঙ্গে কারও ভিন্নমত থাকতে পারে। যেমন খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোয় সাক্ষাৎকার পড়ে মুঠোফোনে আমাদের রোববার বলেছেন, আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যার সঙ্গে তাঁর দ্বিমত আছে। যদিও এটা ঠিক যে ১৬তম সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে আপিল বিভাগ পদত্যাগের বিধানটি উল্লেখ করেননি।

যা হোক, এবার আমরা এটা আশা করব যে এই তিনজন পদত্যাগ না করে তাঁরা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন। পদত্যাগ করে বেরিয়ে এসে রিট করার মাধ্যমে কোনো বৈধতার প্রশ্ন সুরাহার অবকাশ তৈরি যেন না হয়। বিচারপতি ফয়েজী ও বিচারপতি শাহেদুরের পক্ষে আমরা রিট মামলা দেখেছি। এ কারণে তদন্তপ্রক্রিয়া কী উপায়ে হবে, এই মুহূর্তে সেটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে আইনমন্ত্রীর পক্ষে এটা সরাসরি স্বীকার করা কঠিন যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর রয়েছে। কিন্তু তিনি রায়টি কার্যকর এবং তা মানার বাধ্যবাধকতাও স্বীকার করেন। তাই মানতেই হবে যে ওই রায়ে তদন্তপ্রক্রিয়া যেভাবে বলা আছে, সেটাই অনুসরণ করতে হবে। এর বাইরে কোনো পথে যাওয়া অসমীচীন এবং সেটা আইনের শাসন ও সংবিধানসম্মত হবে না। ১৬তম সংশোধনীর আরেকটি বড় দিক হচ্ছে বিচারপতিদের আচরণবিধি সংশোধন করা। ওই রায়ে কোনো অভিযোগ এলে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের কাউকে না জানিয়ে প্রাথমিকভাবে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, সেটা পরিষ্কার করে বলা আছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি, সেটা যেন এবার সম্ভব হয়।

আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়, যা এই মুহূর্তে সবার জন্য অবশ্যপালনীয়, সেটা রায়ের ৩৮ দফায় লেখা আছে। কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে প্রধান বিচারপতি ও পরের দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বসবেন। তাঁদের কেউ বসতে না চাইলে জ্যেষ্ঠতাক্রম অনুসারে বেছে নেওয়া হবে। সুতরাং অচলাবস্থার কোনো সুযোগ নেই। কিংবা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নেই। এর নামকরণ করা হয়েছে ইনহাউস তদন্ত কমিটি। (পৃষ্ঠা ৭৯৫)

 প্রধান বিচারপতি বা যাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ থাকবে, তাঁকে ইনহাউস কমিটিতে রাখা যাবে না। এই ইনহাউস কমিটি–ব্যবস্থা উন্নত দেশের সুপ্রিম কোর্টের অনুসরণে নেওয়া হয়েছে। এই কমিটি অভিযুক্তদের চিঠি দেবে। অভিযুক্তরা লিখিতভাবে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। তাঁদের উত্তর পেয়েইনহাউস কমিটি মনে করলে বিষয়টিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্তযোগ্য মনে করবে। আর তখন তারা এই বিষয়ে কাউন্সিলের বৈঠক বসাতে ও তদন্ত করাতে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবে। রাষ্ট্রপতি অনুমতি দিলে পরে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে। সুতরাং আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন হলো, ইনহাউস কমিটি তিন কর্মরত বিচারপতিকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেবে। তবে এই পর্বে ইনহাউস কমিটি তার পুরো কার্যক্রমের গোপনীয়তা বজায় রাখবে।

বিচারপতি সিনহার ক্ষেত্রে তদন্তের সময় ওই প্রক্রিয়া কেন অনুসরণ করা হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত সাবেক কাউন্সিল সদস্য যুক্তি দেন, ‘আমরা তাঁর বাসায় গিয়ে ব্যাখ্যা চাই। তখন তিনি পদত্যাগের কথা বলেন। তারপর পদত্যাগ না করে ছুটি নিয়ে বাইরে চলে যান।’ এতে বিচারপতি সিনহার বিষয়ে আনা ‘গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ’ সংবিধান অনুযায়ী ‘প্রমাণিত অসদাচরণে’ রূপ নেওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করলেন। এর ফলে মানুষের জানার অধিকার ও স্বচ্ছতার নীতি বজায় রাখা যায়নি। আমরা আশা করব, এবারের পর্বে ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ তৈরি হবে। এখন না হোক, এক শ বছর পরের মানুষ যেন জানতে পারেন।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বলব, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এস এন শুক্লার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করে একটি আদেশদানের অভিযোগ পেলেন। তাৎক্ষণিক তিনি তিন রাজ্যের তিন হাইকোর্ট বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ইনহাউস কমিটিকে দিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করান। এরপর শুক্লা পদত্যাগের অনুরোধ না রাখলে প্রধান বিচারপতি তাঁকে বিচারকার্য থেকে বিরত রাখেন। সম্প্রতি ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে এজাহার দায়েরের অনুমতি দিয়েছেন। কোনো কর্মরত বিচারপতির বিরুদ্ধে এজাহার দায়েরের অনুমতি ভারতে এই প্রথম। সুতরাং দেখার বিষয়, সংসদীয় অভিশংসন ব্যবস্থা বহাল থাকতেও মূল ভূমিকাটা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টই পালন করলেন।

গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে তিন বিচারপতির বিষয়টি প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, ‘হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাঁদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা এবং পরে তাঁরা ছুটির প্রার্থনা করেন।’

সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে সর্বদলীয় সমঝোতা বিরল। এই তিনজনের মধ্যে দুজনই আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং একজন বিএনপির আমলে। কিন্তু এবারের প্রধান বিচারপতির উদ্যোগকে সব দল ও মতের আইনজীবীরা স্বাগত জানিয়েছেন। অনেক দিন পরে এটা বিরাট একটি অগ্রগতি। বারের বিএনপিপন্থী সাধারণ সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে ইতিবাচক বলেছেন। এম আই ফারুকী একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। পারতপক্ষে তাঁকে উদ্ধৃতি দিতে রাজি করানো যায় না। মুঠোফোনে নিজেই ফোন করে বললেন, প্রধান বিচারপতি ভালো পদক্ষেপ নিয়েছেন।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]