শিলাজলে ভাসি যায়, বানরে সংগীত গায়

শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বেশ দাপুটে লোক ছিলেন, ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। রঙ্গ–রসিকতায়ও তিনি কম পারঙ্গম ছিলেন না। তাঁকে নিয়ে একটি গল্প শুনেছি প্রবীণ সাংবাদিক আমানউল্লাহর কাছে। তিনি শুনেছেন তাঁর বাবার কাছে। তাঁর বাবা বিডি হাবীবুল্লাহ শেরেবাংলার খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। এখানে যে গল্পটির অবতারণা করছি, এটি একটি সত্য ঘটনা। বিডি হাবীবুল্লাহ তার সাক্ষী। ঘটনাস্থল কলকাতা।

শেরেবাংলা সবে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। যাঁরা সরকার গঠন করেছেন, তাঁরা কেউ তাঁর পছন্দের নন। স্বভাবতই তিনি ক্ষুব্ধ। এ সময় তাঁর কাছে অনেকেই আসতেন, বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলের। কেউ নানা তদবিরে, কেউবা আর্থিক সাহায্যের আশায়। একদিন এক লোক এসে তাঁর আরজি পেশ করলেন:

আগন্তুক: স্যার, একটু সাহায্য করেন।
শেরেবাংলা: কী সাহায্য?
আগন্তুক: কিছু ট্যাহা দেন।
শেরেবাংলা: ট্যাহা দিয়া কী করবা?
আগন্তুক: হাল চইতে গরু কিনব।
শেরেবাংলা: ট্যাহা তো দিতে পারি। হাটে তো গরু পাইবা না। সব গরু মন্ত্রী হইয়া গেছে।

 ‘হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী’—এ কথা ছোটবেলায় অনেক রূপকথায় পড়েছি। কথাগুলো তো হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। কল্পকাহিনিতেও সামাজিক বাস্তবতার ছোঁয়া থাকে। এটা উন্নত–অনুন্নত সব সমাজেই কমবেশি আছে। একসময় বিটিভিতে ইয়েস মিনিস্টার নামে একটা ধারাবাহিক ছবি দেখেছিলাম। হাস্যরসের মধ্য দিয়েও সমাজের অসংগতিগুলো কী চমৎকারভাবেই না ফুটে উঠত। আমাদের মতো দেশে এ ধরনের ছবি হজম করার মতো মানসিকতা সমাজপতিদের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি।

শেরেবাংলার মন্তব্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মন্ত্রিত্ব কেবল ক্ষমতা নয়। এটি একটি দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টি কেমন যেন অন্য রকম। সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় যে বিষয়টি, তা হলো মন্ত্রীদের বেফাঁস এবং লাগামহীন কথাবার্তা। এ থেকে আমরা কী বুঝব? অযোগ্য লোকেরা মন্ত্রী হচ্ছেন? নাকি মন্ত্রীদের মেধা বোঝার ক্ষমতা আমজনতার নেই?

ষাটের দশকে গভর্নর মোনায়েম খানের কিছু কথাবার্তা হাসির খোরাক হয়েছিল। প্রতি মাসের পয়লা তারিখ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান একটি বেতার ভাষণ দিতেন। মাসের মাঝামাঝি বেতার ভাষণ দিতেন গভর্নর সাহেব। প্রেসিডেন্টকে সম্বোধন করে তিনি সব সময় বলতেন ‘আমার প্রেসিডেন্ট’। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তাঁর শুচিবাই এত প্রবল ছিল যে তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাইকে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘আপনারা রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না?’ জবাবে অধ্যাপক হাই বলেছিলেন, ‘আমি লিখলে তো সেটা হবে আবদুল হাই সংগীত।’ এই লোক একনাগাড়ে সাত বছর গভর্নরগিরি করেছেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, জাতি হিসেবে আমরা কি এতটাই পতিত ছিলাম যে মোনায়েম খানের মতো একজন শাসক এত বছর ধরে আমাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে পেরেছিলেন?

মন্ত্রীদের চালচলন নিয়ে বন্ধুমহলের এক্সক্লুসিভ আড্ডায় অনেক কথাবার্তা হয়, যা ছাপার অক্ষরে লেখার মতো নয়। একদা এই কথাগুলো মুখে মুখে ফিরত—লুকিং ফর শত্রুজ; বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি; দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই; এত দিন কুকুর লেজ নাড়াত, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়।

এখন রেজিম বদলে গেছে। কিন্তু কথাবার্তার ধরন কি বদলেছে? এখনো শুনি—দেয়াল ধরে ঝাঁকি দেওয়ায় রানা প্লাজা ধসে পড়েছে; গাড়িচালককে গরু–ছাগল চিনলেই হবে; উত্তরের মশা দক্ষিণে আসে, দক্ষিণের মশা উত্তরে যায়; ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বামী–স্ত্রীর মতো; বিএনপির লোকেরা চামড়া কিনে তারপর ফেলে দিচ্ছে, এ জন্য সংকট তৈরি হয়েছে; রাবিশ–স্টুপিড ইত্যাদি ইত্যাদি।

কোন কথাগুলো অমৃতবাণীর মতো সব আমলেই শোনা যায়, স্মৃতি আউড়ে তারও একটা চটজলদি জরিপ করে নেওয়া যায়। যেমন বরদাশত করা হবে না; আমরা গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই; আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, এমনতর অনেক অনেক কথা। শুনতে শুনতে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। সাবেক কিংবা বর্তমান মন্ত্রীরা বক্তৃতা শুরু করার আগেই মোটামুটি ধারণা করা যায়, তিনি কী বলবেন। প্রত্যেকেরই কথা বলার নিজস্ব একটা ধাঁচ আছে, আছে কিছু পছন্দের বচন, ‘পেট ওয়ার্ডস’।

একসময় বিটিভি ছাড়া আর কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না। বিটিভি কর্তৃপক্ষকে সব মন্ত্রীর কথাই অল্পস্বল্প কভার করতে হতো। তাদের কৌশল ছিল কাউকে নারাজ না করা। তবে ভয়েস দেওয়া হতো শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। সে যুগ হয়েছে বাসি। এখন ব্যাঙের ছাতার মতো চ্যানেল গজিয়ে উঠেছে। হয়তো আরও গজাবে। এখন সবার ভাষণই চ্যানেলে চ্যানেলে বাজানো হয়। একে তো বিজ্ঞাপনের বিরক্তিকর প্রদর্শনী, তার ওপর মন্ত্রী মহাশয়দের অমৃতবাণী। টেলিভিশনের দর্শক–শ্রোতার আঙুল রিমোটের ওপর নিশপিশ করে। সে এক চ্যানেল ছেড়ে অন্য চ্যানেলে চলে যায়। শেষমেশ দেশের চ্যানেল ছেড়ে বিদেশে যায়।

আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ পরিবেশনার মান নিয়ে অনেক কিছুই বলা যায়। যেখানে সংবাদ থাকে হয়তো ১০ মিনিটের। বিজ্ঞাপন আর অপ্রয়োজনীয় বক্তৃতা–রিপোর্টাজ দিয়ে টেনে টেনে তা এক ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়া হয়।

মন্ত্রী মহাশয়েরা কথা বলতে পছন্দ করেন। সব ব্যাপারেই মতামত দেওয়া চাই। এক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অবলীলায় অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নিয়ে বাকবাকুম করেন। কোনো সীমানা মানেন না। তাঁরা কেউ কেউ বলেন, কথা বলতেই হয়। কেননা সাংবাদিকেরা ছেঁকে ধরেন ছিনেজোঁকের মতো, নাছোড়বান্দা। রিপোর্টারদের নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। তাঁদের অনেক ক্ষমতা। এত দিন শুনে এসেছি, পুলিশ ঘুষ খায়। এখন শুনি পুলিশ ঘুষ দেয় রিপোর্টারদের। রিপোর্টারদের অনেকেই ঠিকঠাক প্রশ্ন করতে জানেন না। প্রশ্নের মধ্যেও অনেক সময় জিলাপির প্যাঁচ থাকে। তাঁদের যাঁরা বস, তাঁরাও অধস্তনদের ঠিকমতো ব্রিফ করেন বলে মনে হয় না। সব জায়গায় নৈরাজ্য।

আবার মন্ত্রীদের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। তাঁদের মুখে কুলুপ এঁটে রাখার কথা বলা হচ্ছে না। কথা হলো, কী বলবেন, সেটা একটু সংক্ষেপে গুছিয়ে বললেই হলো। তাঁরা দলের লোক হিসেবে মন্ত্রিত্ব করছেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তাঁরা প্রশাসন চালান। তাঁদের ১৬–১৭ কোটি মানুষের কথা ভাবা দরকার। দল থেকে ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। কিন্তু দেখভাল করতে হবে দেশের। দলের কথা ভাবলে দলীয় পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা দরকার। এ ব্যাপারে পরিমিতিবোধের বড়ই অভাব।

তবে এ কথা সত্য যে এমন অনেকের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়েছে, যাঁদের উঁচু পদে বসার কথা নয়। কিন্তু গণমাধ্যমের কল্যাণে তাঁরা কোটি কোটি নাগরিকের নজরদারিতে থাকেন। নাগরিকদের তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে বা আমলে না নিয়ে যা খুশি বলা বা করার এখতিয়ার তাঁদের নেই।

গত পাঁচ দশকে এ দেশে অনেকেই মন্ত্রী হয়েছেন। সবার নাম সবাই বলতে পারবেন না। অনেকেই মনে রাখার মতো কাজ করেননি। আবার অনেকেই অকাজ–কুকাজ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁদের অনেকের কথাবার্তা শুনলে হোঁচট খেতে হয়। মনে ভাবনা আসে, এই লোক আমাদের মন্ত্রী? তখন কবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ওই চরণটির কথা মনে পড়ে যায়:
শিলাজলে ভাসি যায়,
বানরে সংগীত গায়,
দেখিলেও না হয় প্রত্যয়।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]