পর্যটন অর্থনীতির নতুন জানালা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কক্সবাজার থেকে ফিরছি। এয়ারপোর্টে একজন রোমানীয় নারীকে দেখলাম বোর্ডিং পাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। সামান্য সময়টুকু নষ্ট করছেন না, তাঁর ট্যাবে কাজ করছেন। তিনি এসেছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করতে। একটি এনজিওর পক্ষ থেকে। এখন তিনি ফিরে যাচ্ছেন, তাঁর কয়েক মাসের কাজের মেয়াদ শেষ। তিনি বললেন, কক্সবাজারের মানুষ এত ভালো! খুব সহজ-সরল। যেখানেই গেছেন, সম্মান পেয়েছেন। সাধারণ মানুষের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ।

তিনি আরও বললেন, কক্সবাজারের সমুদ্র চমৎকার। আবহাওয়া ভালো। খুব বেশি শীত নেই, তেমন গরমও নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ তুলনাহীন। বললেন, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো কাজে যুক্ত। এ অঞ্চলের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা খুব বেশি বলে তিনি মনে করেন। শুধু একটা সামান্য উদাহরণ দেখুন। এই ঈদে ছয়-সাত দিনের টানা ছুটি ছিল। এই কয়েক দিনে কক্সবাজারে ছয় লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। আগে বর্ষাকালে পর্যটক খুব কমই আসতেন। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। শীত-গরম-বর্ষা সব সময়ই পর্যটকের ভিড়।

কক্সবাজারে এখন পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল চালু রয়েছে। গত কয়েক দিন সব কটি পর্যটকে ঠাসা ছিল। কেনাকাটাও হয়েছে প্রচুর। সমুদ্রতটে দিনরাত পর্যটকের ভিড়। কম করে হলেও ৩০০-৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। শুধু কি তা-ই। কক্সবাজারে এখন পাঁচতারা হোটেল আছে প্রায় আটটি। ওগুলোর প্রতিটিতেই ঠাঁই নাই অবস্থা। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে আসা বিদেশি এনজিও কর্মকর্তারা যেমন থাকেন, তেমনি দেশের সচ্ছল ব্যক্তিরাও সব সময় আসেন, থাকেন দু-চার দিন। আরামে কিছু সময় কাটিয়ে যান।

মোটকথা, দেশি-বিদেশি লোকজনে এখন কক্সবাজার জমজমাট। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও বেশ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরটাও মাত্র বছরখানেক আগে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। এখন বহির্গমন লাউঞ্জ একেবারে ঝকঝকে-তকতকে। এ বছরের শেষ দিকে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত হবে, এমন পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চালু হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কক্সবাজার সারা বছর পর্যটকে জমজমাট থাকবে।

কক্সবাজারে ৬৯টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেল যোগাযোগ তো রয়েছেই, আরও আছে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, টেকনাফে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন নির্মাণ এবং এ ধরনের আরও অনেক বড় প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কক্সবাজারকে আর চেনা যাবে না। এখনই চেহারা বদলে যাচ্ছে। ছোটখাটো কর্মচঞ্চল নগরই বলা যায়। সুউচ্চ ভবন গড়ে উঠছে। সব কটিই হোটেল-মোটেল। শহর বাড়ছে। সমুদ্রসৈকতও দীর্ঘতর হচ্ছে। সেখানে সারি সারি ছাতার নিচে গদি বিছানো কাঠের চেয়ার। সৈকত একদম পরিষ্কার। এখন আর কেউ যেখানে-সেখানে কলার খোসা বা প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলে না। নির্দিষ্ট ঝুড়ি ব্যবহার করে। সৈকত এখন বেশ নিরাপদ। পর্যটকদের ভয়ে থাকতে হয় না।

সন্ধ্যায় এমনকি মধ্যম মানের হোটেলগুলোও জমজমাট। সেখানে দেশি পর্যটক যেমন, তেমনি আসেন বিদেশি এনজিও কর্মকর্তা-কর্মীরা। তাঁরা ডিনারের মধ্যে তাঁদের কাজের বিষয়ে কথাও সেরে নেন। দুই দিন ছিলাম কক্সবাজারে। মেরিন ড্রাইভে বেশ কিছু দূর ঘুরে এসেছি। আগেও গেছি। কিন্তু তখন দেখতাম নির্জন। এখন সারাটা পথেই লোকজনের চলাফেরা। মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশে খোলা চত্বরে চায়ের ছোট ছোট দোকান। সেখানে নেমে সমুদ্রের দৃশ্য দেখতে দেখতে পর্যটকেরা চা খাচ্ছেন। তা ছাড়া একটু দূরে দূরে রয়েছে বিভিন্ন রিসোর্ট। সেখানে রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। আবার শুধু চা অথবা ডিনারও করা যায়। দেশি পর্যটকেরাই সেখানে বেশি।

মেরিন ড্রাইভের এক পাশে উত্তাল সমুদ্র, আরেক পাশে পাহাড়। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। মনে পড়ল রোমানিয়ার সেই নারীর কথা। তিনি যখন কক্সবাজারের পরিবেশ ও মানুষের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল আমাদের কক্সবাজার হয়তো দ্রুতই বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর হয়ে উঠবে।

তবে সমস্যা আছে। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে কক্সবাজারের উন্নয়ন পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো মাদকের বিস্তার। এখন যদিও অভিযানের ফলে কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু সমস্যার বীজ থেকেই যাচ্ছে। পর্যটন ব্যবসার জন্য এটা বড় হুমকি।

তারপরও বলব, কক্সবাজার কক্সবাজারই। এর আবেদন সহজে নষ্ট হবে না। সে তার নিজস্ব শক্তিতেই পর্যটনশিল্পের সব সম্ভাবনা কাজে লাগাবে। আর সেখানে খুলবে পর্যটন অর্থনীতির এক নতুন জানালা।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]