বেতের ভয়ে ছাত্রদের পলায়ন

পৃথিবীর অধিকাংশ ‘স্টেরিওটাইপ’ বা একধাঁচি ধারণাই ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, এটি বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রচলিত ধারণাকে জমিয়ে তোলার একমাত্রিক উপায় হিসেবে কাজ করে। একধাঁচি ধারণার কারণেই ‘শিক্ষকদের পড়া আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রহার করা ভালো’—এই তত্ত্ব একটি প্রশ্নাতীত পবিত্র জ্যোতি পেয়েছে। যুগে যুগে শিক্ষক নামধারী কিছু ব্যক্তি সেই জ্যোতির অপব্যবহার করে এসেছেন। 

এই ‘পবিত্র জ্যোতি’র ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে একসময় অভিভাবকেরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের হাতে সমর্পণের সময় বলতেন, ‘সন্তান আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। হাড্ডি আমার, মাংস আপনার।’ অর্থাৎ সন্তানকে সুশিক্ষিত করার প্রয়োজনে তাঁরা শিক্ষককে শারীরিকভাবে প্রহারের অনুমোদন দিতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পড়া আদায়ে বেত্রাঘাত বা এ ধরনের প্রহার মোক্ষম কোনো উপায় হতে পারে না। বরং এটি শিক্ষার্থীর মনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি স্পষ্টতই অন্যায়। প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ যদি অন্যায়কে জীবনের আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে মেনে নেয় এবং সেই অন্যায় ধারণা ও পীড়নকে শিক্ষার্থীদের ‘গুরুদীক্ষা’ বলে গেলাতে থাকে, তাহলে পরিণতি সুখকর হয় না। 

মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী চারজন বালক শারীরিক শাসনের মুখে পড়ে কী পরিমাণ ভীতিগ্রস্ত হলে গভীর রাতে আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়, তা সহজেই অনুমেয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী রুস্তমহাটের একটি মাদ্রাসায় সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে বলে খবর বেরিয়েছে। ওই বালকেরা বলেছে, শিক্ষকদের বেতের বাড়ি সইতে না পেরে মধ্যরাতে মাদ্রাসা থেকে তারা পালিয়েছিল। 

এই চার শিক্ষার্থী ‘দারুল তাকওয়া লি-তাহফীজিল কুরআনিল কারীম’ মাদ্রাসার ছাত্র। রাত ১০টার দিকে সেখানকার ছাত্রাবাস থেকে পালিয়ে যায় তারা। চারজন পারকি এলাকার দিকে চলে গেলে রাত দেড়টার দিকে স্থানীয় লোকজন তাদের থামায়। পরে তাদের অভিভাবকদের খবর দেওয়া হয়। ওই মাদ্রাসায় প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে পড়ান আটজন শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেতন নেওয়া হয়। এক শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘হুজুরেরা খুব মারে। মা-বাবাকে জানালে তারাও মারে, তাই চলে এসেছি।’ 

মাদ্রাসাসহ অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মনে রাখা দরকার, প্রাচীন শিক্ষাদানের পদ্ধতি এই যুগে অচল। তার চেয়ে বড় কথা দেশের প্রচলিত আইন শিশুদের মারধর করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। অন্তত আইনের কথা মাথায় রেখে এই ধরনের শারীরিক পীড়ন থেকে তাঁদের সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে শিক্ষকদের সচেতন ও সতর্ক করতে সরকারের পক্ষ থেকে জোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।